আজ [bangla_date], [english_date]

সাংবাদিক নান্নুর অগ্নিদগ্ধ ‘হত্যা’

বিশেষ প্রতিনিধি : নিজ ফ্ল্যাটের যে কক্ষে ছেলে আগুনে পুড়ে মারা গেল, সেই কক্ষে একইভাবে মারা গেলেন বাবাও। অগ্নিদগ্ধ যুগান্তরের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার ও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু মারা গেছেন। শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পার্থ শঙ্কর পাল তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ক্রাইম রিপোর্টারসহ সাংবাদিক সমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর আফতাব নগরে তার নিজ বাসায় রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নান্নুর শরীরের ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। পরে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) প্রায় ৪৮ ঘন্টা জীবনযুদ্ধে লড়ে নান্নু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ ঘটনার ছয় মাস আগে ২ জানুয়ারি ওই বাসায় এসি বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তার ছেলে স্বপ্নীল আহমেদ পিয়াস (২৪) মারা যান। সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু রাজধানীর বাড্ডা থানাস্থ আফতাব নগরের বাসায় হঠাত এক বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে নান্নুর স্ত্রী দাবি করেছেন। তবে আগুনের লেলিহান শিখায় নান্নু পুড়ে মারা গেলেও সে আগুনের তাপ তার স্ত্রী শাহীনা আহমেদ পল্লবীকে ছুঁতে পারেনি। এক প্রশ্নর জবাবে পল্লবী জানান, মধ্যরাতে লেটনাইট ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার পর নান্নু তার স্ত্রীকে নিয়ে একসঙ্গেই পানাহার করেন। পরক্ষণেই প্রয়াত ছেলে পিয়াসের তালাবদ্ধ রুম খুলে বৈদ্যুতিক বালভের সুইচ অন করতেই বিস্ফোরণের শব্দ হয় এবং নান্নু মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। এসময় তার স্ত্রী পাশে থাকলেও অলৌকিকভাবে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ থাকেন তিনি। সাংবাদিকরা জানান, ছেলের পর একই ভাবে সাংবাদিক নান্নু ভাইয়ের আগুনে নির্মম মৃত্যুর ঘটনাটি ক্রমেই নানা রহস্যের সৃষ্টি করেছে। একমাত্র ছেলে পিয়াস মৃত্যুর মাত্র ৫ মাসের মধ্যে একইদিন (বৃহস্পতিবার) এবং প্রায় একই সময় ভোররাতে সেই অভিশপ্ত কক্ষে একইভাবে আগুনে পুড়ে যুগান্তরের ক্রাইম চীফ নান্নুর রহস্যময় অগ্নিদগ্ধের শিকার হন। আফতাবনগরের বি ব্লকের তিন নম্বর সড়কের একটি দশতলা ফ্ল্যাট বাড়ির দশম তলাতে পরিবার নিয়ে থাকতেন মোয়াজ্জেম। আগেরবার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ফ্ল্যাটের মেরামত শেষ হওয়ার পর গত ৩১ মে স্ত্রী শাহান হোসেন পল­বী ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে আবার নিজের ফ্ল্যাটে ওঠেন মোয়াজ্জেম। ১ হাজার ৯১০ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাট। মোয়াজ্জেমের স্ত্রী শাহানা হোসেন পল্লবী গতকাল বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত দুইটায় অফিস থেকে ফিরে গোসল করে রাতের খাবার খান মোয়াজ্জেম। এরপর তাহাজ্জতের নামাজ পড়তে ওই কক্ষে গিয়েছিলে। তিনি ছিলেন পাশের কক্ষে। হঠাৎ বিকট শব্দ পেয়ে গিয়ে দেখেন আগুন লেগেছে এবং পিঠে আগুন নিয়ে মোয়াজ্জেম পাশের টয়লেটে ঢুকে গোসল করছেন। আগুনের সূত্রপাত প্রসঙ্গে ইঙ্গিত করে শাহানা পল্লবী বলেন, তাঁদের ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেত। কয়েক দিন আগে মিস্ত্রিরা এসে লাইন পরীক্ষা করে বলেছিল বাথরুমের কমোড থেকে গ্যাস উদগীরন হয়ে থাকতে পারে। মোয়াজ্জেম মিস্ত্রিকে শুক্রবার এসে কমোড খুলে ঠিক করার কথাও বলেছিলেন। তার আগেই এই ঘটনা ঘটল বলেও দাবি করেন শাহানা পল্লবী। অপর ক্রাইম রিপোর্টার জামিউল আহসান সিপুর কাছেও নান্নুর স্ত্রী পল্লবী দাবি করেন, মাঝে মধ্যে ফ্ল্যাট থেকে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেত। এজন্য মিস্ত্রি আনিয়ে অন্তত চার বার চেকও করা হয়েছিল। তবে বাসার ব্যবস্থাপক মনসুর আলম বলেছেন, কারও ফ্ল্যাটে কোনো সমস্যা হলে এর দেখভাল সব সময় তিনিই করেন। মোয়াজ্জেমের ফ্ল্যাটের গ্যাসলাইনের রাইজারে একটি সমস্যা ছিল। গত ৩১ মে তাঁরা যখন বাসায় ওঠেন, তখনই রাইজারটি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। এরপর গ্যাসের কোনো সমস্যার কথা মোয়াজ্জেম বা তাঁর স্ত্রী কখনও তাকে এমন কোনো সমস্যার কথা জানাননি। বাড়ি ব্যবস্থাপকের এ কথায় শাহানা পল্লবীর বক্তব্যের গড়মিলকে কেন্দ্র করে রহস্যময়তার সৃষ্টি হয়। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. পারভেজ ইসলাম জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, রাতে স্বামী-স্ত্রীর তুমুল ঝগড়ার শব্দ পাওয়া গেছে। এরপরই আগুনের ঘটনা ঘটে। ওসি বলেন, আগুনের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নান্নুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রতিবেশী আশিক টুটুল বলেন, হাসপাতালের নিয়ে যাওয়ার সময়ও তাঁর চেতনা ছিল। নান্নু সে সময় কথাও বলছিলেন স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু আগুন কীভাবে লেগেছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।

সহকর্মি সাংবাদিকরা বলেন, সাংবাদিক নান্নুর নির্মম মৃত্যুর আগে পরের বিভিন্ন ঘটনা যথেষ্ঠ সন্দেহের সৃষ্টি করেছে, জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। সেসব বিষয়ে স্বচ্ছ তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন তারা।

——————
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রগুলো ভিন্ন প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন তুলেছে-হাসপাতালে নান্নুর স্ত্রীকে সার্বক্ষণিক গাইড দেয়া লোকগুলো কারা? নান্নুর স্ত্রীর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে অবস্থান নেয়া লোকগুলো বারবারই তাকে গণমাধ্যম কর্মিদের এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিতে থাকেন।

সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর স্বশুর বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া। আর পাশের থানা অভয়নগরে তার নিজ বাড়ি। কিন্তু ছেলে পিয়াসের মতো নান্নুকেও বাঘারপাড়াস্থ স্বশুর বাড়িতে কবরস্থ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তার নিজ বাড়ি কবর না দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে কেন কবর দেওয়া হচ্ছে তো নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে নান্নুর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহকর্মি তার বাবা-মা, ভাই-বোনদের বরাত দিয়ে জানান, তারা কেউ নান্নুর বাসায় কখনো ঠাঁই পাননি-এ কারণে কোনো যোগাযোগও ছিল না বললেই চলে। এজন্য পরিবারের সদস্যরা নান্নুর স্ত্রীকে বরাবর দায়ী করলেও স্ত্রী পল্লবী বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি দাবি করেন, নান্নুর সঙ্গে জায়গা জমি নিয়ে তার ভাই-ভাতিজাদের বিরোধ থাকায় ঘনিষ্ঠতা ছিল না, আসা-যাওয়াও বন্ধ ছিল।

সহকর্মিদের ভেজা চোখ : কষ্ট কান্না
নান্নুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মিরা জানান, তার কাছে জায়গা জমির ব্যাপার নিয়ে মাঝে মধ্যেই নানা হতাশা ব্যক্ত করতেন নান্নু। বলতেন, আমার অবর্তমানে নিজের সহায় সম্পদগুলো বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে তার সব সম্পত্তি বিক্রি করে এতিমখানাসহ আশ্রম কেন্দ্র খোলার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন নান্নু।

সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানায়, বাসার গ্যাসলাইন নিয়ম মেনে হয়নি, সংযোগ অবৈধও হতে পারে। তাছাড়া তার বাথরুমের কমোডেও ঘন ঘন গ্যাস জমে ওঠার নজির থাকারও দাবি করা হয়েছে। সূত্রটি আরো জানায়, পিচ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের তৈরি পিচ তাজমহল নামের অ্যাপার্টমেন্টটির নির্মান কাজ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। পিচ ডেভেলপমেন্টই নান্নু ভাই ও তার সন্তান পিয়াসকে হত্যার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। পিচ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে নির্মান কাজে ত্রুটি থাকার অভিযোগ করা হয়েছে।

শাহাবুদ্দিন চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে জানালেন, ক্র্যাবের ফ্যামেলি ডে’তে নান্নুর সঙ্গে দেখা হয় সর্বশেষ। বুকে জড়িয়ে ধরতেই গুমরে কেঁদে ওঠলো। সেখানকার কফি চত্ত¡রের পাশে কথা হচ্ছিল আমাদের। প্রয়াত ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই চোখ ছলছল করে ওঠে তার। আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ছেলের স্মৃতি ধরে রাখতে এলাকায় মাদরাসা-মসজিদ-এতিমখানা করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার কথাও জানালো। তাহাজ্জুত নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করার কথা বলতেই চাপা কান্না লুকাতে চাইলো। জড়িয়ে ধরলাম। মনের অজান্তে আমারও চোখও ভিজে উঠলো।

নান্নু এবং তার ছেলে পিয়াসের আগুনে মৃত্যু নিয়ে মিজান মালিকের প্রশ্ন
————————————————————————–
১. নান্নু ও তার ছেলের মৃত্যুর ঘটনা শুধুমাত্র গ্যাস বা এসি বিস্ফোরণের ঘটনা? রান্না ঘর থেকে আগুন লাগলে সেখানে কী কোনো চিহ্ন থাকবে না?
২.গ্যাস লাইনে সমস্যা হলে অন্য কোনো ফ্ল্যাটে কেনো একদিনও গ্যাস লিক হয়নি?
৩.নান্নুর ছেলে যে কক্ষে যেভাবে অগ্নদগ্ধ হয়েছে একই কায়দায় নান্নুরও কেনো মৃত্যু হবে?
৪.নান্নুর ছেলে যে রাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় সেই রাতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যে শব্ধ পেয়েছে একই ধরনের শব্দ এবারও কেনো?
৫. আগুনের খবর পেয়ে ভবনের বাসিন্দারা সবাই ভয়ে তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসে। যদি আগুন ওই ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটে চলে যায় সেই ভয়ে। কিন্তু আর কোনো ফ্ল্যাটেই আগুন না গিয়ে একটি কক্ষ আর সেই বারান্দায় কেনো স্থির হয়ে কয়েক মিনিট পর নিভে যায়?
৬. দুবারই ফায়ার সার্ভিসের লোক এসেও তাদের আগুন নেভাতে হয়নি। তারা শুধু অগ্নিদগ্ধ দুজনকে ধরা ধরি করে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে তাদের অভিজ্ঞতা কী বলে?
৭. নান্নু এমনিতে খুব অসুস্থ। তার সুগার লেভেল অনেক উচ্চ থাকে। এ কারনে শারীরিক ভাবে খুব দুর্বল। রাতের কোনো একটা সময় কিসের শব্দ পেয়েছিল ভবনের বাসিন্দারা?
৮.ওই রাতে নান্নু ছাড়া আর কে ছিলেন বাসায়? তাদের ভূমিকা কী ছিল? তারা কি আগুন নেভাতে চেষ্টা করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে তাদের কেউ কি সামান্য হলেও আহত হয়েছেন?
৯.চুলার গ্যাস কি ওই কক্ষ পর্যন্ত যায়?
১০. গান পাউডার নামক কোনো কিছু কী ব্যবহার করা হয়েছে?
১১. নান্নুর ছেলেকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে?
১২. নান্নুর ছেলের মৃত্যুর দিনই কক্ষটি কী পরিষ্কার করা হয়েছিল? আলামত সংগ্রহ করা হয়েছিল কী?
১৩.তখন না হয় স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে পুলিশ কক্ষ থেকে কোনো নমুনা বা আলামত সংগ্রহ করেনি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় নান্নুর মৃত্যুর পর তো নানা কথা হচ্ছে। পুলিশ কী বাসাটি এখন সিলগালা করবে?
১৪. ঘটনার সঠিক তদন্ত কী হবে? বাড়ির ম্যানেজার সিকিউরিটি গার্ড ও অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে কথা বলবে কী?
১৫. সঠিক তদন্তে যদি এটা প্রমাণিত হয় এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং নান্নুর কাছের স্বজন জড়িত তার বিরুদ্ধে কি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে?
প্রশ্ন তুলেছেন ডাকসাইটে ক্রাইম রিপোর্টার আমিনুর রহমান তাজ
১। হাসপাতাল চত্বরে কালো বিলাসবহুল গাড়িতে করে আসা লোকজনের উপস্থিতি। তারা গনমাধ্যম কর্মীদের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করে।
২। ময়না তদন্ত না করা।
৩। মৃত্যুর আগে নান্নু বলেছিলো তার সহায় সম্পত্তি এতিমখানা মসজিদে দান করে যাবে।
৪। ঘটনার দিন রাতে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া৷ (প্রতিবেশীদের উদ্ধৃত করে ওসির বক্তব্য)।
৫। একজন স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর যেভাবে শোকার্ত হওয়ার কথা তা পরিলক্ষিত না হওয়া।
৬। যে ঘরে গ্যাস থেকে আগুন লাগার বলা হচ্ছে সেখানে গ্যাসের সংযোগ না থাকা।
৭। নিচের প্রতিবেশী বলেছেন, তারা ধুপধাপ শব্দ শুনেছেন উপরে।

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page

error: sorry please