আজ [bangla_date], [english_date]

মন্তব্য প্রতিবেদন

মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড : উৎকন্ঠা বেড়েই চলেছে

 সাঈদুর রহমান রিমন : মেজর সিনহা’র হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে ‍রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নানাভাবে আমার সঙ্গে বন্ধন গড়েছেন, যোগাযোগ রাখছেন। তাদের অনেকেই ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, মেইলে এবং মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ আমার জীবন বিপন্নতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সাবধানতার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের উদ্বেগের কারণ দুটি।
এক. মেজর সিনহার খুনিরা সাধারণ দুর্বৃত্ত নন, তারা প্রভাবশালী সিন্ডিকেট মেইনটেন করে থাকেন। দেশের মাদক বাণিজ্য, মানব পাচার, অস্ত্রশস্ত্র বেচাকেনা থেকে শুরু করে ধনাঢ্য শ্রেণীর সঙ্গে নানারকম যোগসূত্র গড়ে তারা হয়ে উঠেছেন সর্বেসর্বা। তাদের প্রধানতম টার্গেট হয়ে কতটুকু সময় আমার জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে-তা নিয়েও শুভাকাঙ্খীদের উদ্বেগের শেষ নেই। দুই. কতিপয় সাংবাদিকও যখন এই চক্রের সহযোগী হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠে তখন উদ্বেগের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণ। চিহ্নিত সাংবাদিকদের কেউ কেউ যখন প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ইলিয়াস কোবরাকে রিপোর্টারের বিরুদ্ধে মামলা করতে উস্কানি দেন তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে তারা কতটুকু নোংরামির পথ বেছে নিয়েছেন। একটি চ্যানেল এবং একজন ফেসবুক লাইভধারী সাংবাদিক ইলিয়াস কোবরাকে প্রশ্নের নামে যখন বারবার “এখনো কেন মামলা করছেন না, মামলা কখন করবেন ? ইত্যাদি বলে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেন তখন তাকে নিছক দালাল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না দর্শক শ্রোতারা। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে সম্মানের জায়গা থেকে একচুলও নামাতে পারি না কারণ, সভ্যতার শিক্ষাটা এমনই হওয়া উচিত। এসব অপকর্মের কারণে এ প্রজন্মের অনেকের কাছেই – গ্রাম্য একশ্রেণীর অকর্মা নারীর মতো কুটনামি, বদনামি আর পক্ষপাতিত্বের দালালিকেই সাংবাদিকতা বলা হয়। এরা মূলত: ওসি প্রদীপ আর দারোগা লিয়াকতের রক্ষাকবচ হয়ে উঠার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় মাঠে নেমেছে। কাজের বিনিময়ে মজুরির ভিত্তিতেই তাদের দৈনন্দিন জীবন কাটে। হায় সাংবাদিকতা ! হায় দুর্ভাগ্য !! সে যাই  হোক-দিন যতই গড়াচ্ছে ততোই উদ্বিগ্ন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন মানুষজন মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা পড়ে যাওয়া নিয়েই বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। দেশের সচেতন মহল রীতিমত হতাশ। তারা যেন বুঝেই গেছেন যে, নানামুখি প্রচার প্রপাগাণ্ডায় মেজর হত্যা মামলার ভবিষ্যত শেষ- তবে এ ঘটনাকে ঘিরে দেশকে আরো কোনো ধকল পোহাতে হয় কি না সে চিন্তাতেই অস্থির তারা। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আদালত থেকে রিমান্ড মঞ্জুর করার পর ১০ কার্যদিবসেও সিনহা হত্যা মামলার মূল আসামি বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও বরখাস্ত হওয়া সাব ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা তার হেফাজতেই নিতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদ তো আরো পরের কথা। এরমধ্যেই তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছেন, তদন্তের দায়িত্বভার পেয়েছেন র‌্যাবের সহকারী পরিচালক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম। তদন্ত কমিটির মতো মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও গণশুনানীকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একই ভিউ পয়েন্ট থেকে একই বিষয়বস্তু দেখা শত শত জনকে সাক্ষী বানানো মানেই কিন্তু মামলা খুব জোড়ালো হওয়া নয়-বরং বিচারের ক্ষেত্রে তা দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টিরও অসংখ্য নজির রয়েছে।

সাধারণ মানুষের আরো আরো উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সারমর্ম তুলে ধরলে যা দাঁড়ায়—

* মেজর সিনহা হত্যা মামলায় শিপ্রা-সিফাতকে ঘিরে যেসব বিতর্ক ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তা কেবলই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতাকে চাপা দেয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অথচ একশ্রেণীর ফেসবুক বিশেষজ্ঞ  নানা কৌশলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইলিয়াস কোবরা, শিপ্রা-সিফাতের নোংরাপনার নানা ছবি-ভিডিও হাজির করে বিতর্ক ছড়িয়েই চলছে। এ কৌশলে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি কিছুটা অন্যদিকে সরাতেও সক্ষম হয়েছেন তারা। কোবরার ভক্তদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন ওসি প্রদীপের সহযোগিরা পুরো বিষয়টি চাপা দিতে টাকা ছিটিয়ে নতুন কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্ম দেয়ার পাঁয়তারা চালালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

* ঘটনার দিন দুপুর ২টার মধ্যে নীলিমা রিসোর্টে খাওয়া দাওয়া শেষ করেই মেজর সিনহা তার সহযোগী সিফাতকে নিয়ে গাড়িযোগে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। থানা ঘুরে কোবরা বাজার হয়ে মারিসবুনিয়া পাহাড়ে যান সন্ধ্যার দিকে। ওই  রিসোর্টে ঘুমিয়ে থাকা শিপ্রার উদ্বৃতি দিয়ে কেউ কেউ প্রচার করছেন যে, সিনহা থানায় বা অন্য কোথাও যাননি। রিসোর্টে ঘুমন্ত শিপ্রা এ তথ্য কিভাবে নিশ্চিত করে তা বোঝার সাধ্য কারো থাকে না! বেলা আড়াইটায় নীলিমা রিসোর্ট থেকে বের হলে বড়জোর সোয়া তিনটার মধ্যেই সিনহা ও সিফাতের মারিসবুনিয়া পাহাড়ে পৌঁছানোর কথা-কিন্তু তারা সেই পাহাড়ে যান সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। তাহলে বাকি সোয়া তিন ঘন্টা কোথায় কাটালেন সিনহা? শিপ্রা ও তার ভক্তদের কাছে তার জবাব নেই।

*উচ্চ ক্ষমতার তদন্ত কমিটির অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড’র মোটিভ উদঘাটনের ব্যাপারকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ হত্যাকান্ডটি পরিকল্পিত নাকি অতর্কিত? এ প্রশ্নকে সামনে নিয়েই যাবতীয় বিশ্লেষণ চলছে। তবে গুলিবর্ষণের ১৫ মিনিট পরে পৌঁছেও ওসি প্রদীপ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ মেজর সিনহার নিথর দেহে লাথি মারা এবং পুণরায় গুলি চালানোতে তার পূর্ব আক্রোশই ফুটে ওঠেছে। পূর্ব আক্রোশ আর পূর্ব পরিকল্পিত শব্দদ্বয়ের চুলচেরা বিভাজন করে দেখছেন তদন্ত কমিটির বিজ্ঞজনরা।

*  মেজর হত্যার পূর্বাপর সরাসরি সম্পৃক্ত  কক্সবাজারের এসপি এ বি এম মাসুদ হোসেন। তার নির্দেশনা ও পরিকল্পনা মোতাবেকই ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকত শামলাপুর চেকপোস্টে মেজরের হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। যে টেলিফোন রেকর্ড প্রকাশ হয়েছে তাতে এসপি সাহেব ওসিকে ঘটনা ঘটাতে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা স্পষ্ট ৷ আবার এসআই লিয়াকতকে তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন যে, ‘তোমাকে গুলি করেছে তা তোমার গায়ে লাগেনি, আত্মরক্ষার্থে তুমি যে গুলি করেছো তা তার গায়ে লেগেছে৷ সেই এসপিকে স্বপদে স্বস্থানে বহাল রেখেই সিনহা হত্যা মামলাটি প্রভাবমুক্ত তদন্তের আশা করা মানে বোকার স্বর্গে বাস করা।

* মেজর হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যাবের হাতে ন্যস্ত হওয়ার পর থেকেই কক্সবাজারের জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন তার নিয়ন্ত্রিত জেলা গোয়েন্দা বিভাগকে ব্যস্ত সন্ত্রস্ত করে রেখেছেন। জেলা গোয়েন্দা সদস্যরা মেজর সিনহা হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন, পুলিশের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার নির্দেশ জারি, থানার ভিডিও ফুটেজ সরিয়ে ফেলা, মেজর সিনহার গাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা ল্যাপটপের হার্ডড্রাইভ, ক্যামেরার মেমোরি কার্ড, পেনড্রাইভ এবং রেস্ট হাউজ থেকে জব্দ করে নেওয়া মেমোরি কার্ডগুলো অনুসন্ধান করে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, এসএমএস উদ্ধার করে তা ছড়িয়ে দেয়ার কাজেই সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকছে বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে।

* একটানা ২৬ দিন ধরে মেজর সিনহা ও তার সহকর্মিরা পর্যটন বিষয়ক ডকুমেন্টারি কাজ চালাচ্ছিলেন কক্সবাজার, হিমছড়ি, ইনানী ও টেকনাফ এলাকায়। টিমসহ তার অবস্থান ছিল ইনানীর নীলিমা রিসোর্টে। সেখানে পর্যটন বিষয়ক ডকুমেন্টারিতে মডেল হতে আগ্রহীদের অনেকেই নীলিমা রিসোর্টে যাতায়াত করতেন, দেখা করতেন সিনহার টিম সদস্যদের সঙ্গে। তবে সম্ভাব্য এসব মডেলদের মধ্যে এসপি এবিএম মাসুদ সাহেবের ঘনিষ্ঠজনরা কেউ সেখানে যাতায়াত করতেন কি না-তা নিশ্চিত করা যায়নি। নীলিমা রিসোর্টের কর্মিরা জানিয়েছেন, এসপি সাহেবের স্ত্রী মাঝে মধ্যেই আসতেন-তিনি প্রকৃতিপ্রেমী নারী, খুবই ভাল মানুষ।

*  সিফাত ও শিপ্রা ঘটনার আকস্মিকতায় মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত রয়েছেন বিধায় মামলার তদন্তকারী র্যাব অফিসার তাদের সাক্ষ্য গ্রহণে বিলম্ব করছেন বলে জানিয়েছেন।   কিন্তু শিপ্রা ফুরফুরে মেজাজে তাদের ইউটিউব চ্যানেল যখন মার্কেটিং করে বেড়ান, সাবলীলভাবে বক্তব্য দেন, হাসি-ইয়ার্কী করেন, ইউটিউব চ্যানেলের মালিকানা দাবি করতে পারেন- তখন মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে তাদের আর কোনো সমস্যা থাকতে পারে না? এ দু’জনের সাক্ষ্য না নেয়ার কারণে ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকেও নাকি র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছে না।

* মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সরব হয়ে উঠে-ঠিক সেই সময়ই ইলিয়াস কোবরা ও শিপ্রার ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ও বিতর্ক ছড়িয়ে দেয়া আইডিগুলোর বেশিরভাগই পুলিশ সদস্যদের। শুধু নানা বিতর্ক জুড়ে দিয়ে মেজর সিনহা হত্যার আলোচনাকে চাপা দিতে সংশ্লিষ্ট জ্ঞ্যাতি ভাইয়েরা মাত্র ১০ দিনের মধ্যে শতাধিক ফেসবুক আইডি তৈরি করেছেন। এসব নতুন আইডি অথবা পরিবর্তিত আইডি থেকেই বিতর্ক উস্কে দেওয়া হচ্ছে।

* টেকনাফের বহুল বিতর্কিত ওসি, শামলাপুর চেকপোস্টে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের আসামি প্রদীপ কুমার দাসকে গত ৫ আগস্ট সাময়িক বরখাস্তের পর তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় থানারই সেকেন্ড অফিসার এবিএম দোহা। সবশেষে চান্দিনা থানার ওসি মো. আবুল ফয়সলকে টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফের ছেলে আবুল ফয়সল টেকনাফ থানায় দায়িত্ব নিয়েই প্রদীপের যোগ্য অনুসারী হয়ে উঠেছেন। মেজর সিনহা হত্যা মামলা তদন্তকারী সংস্থা র্যাব কর্তৃক তিন সন্দেহভাজন গ্রামবাসীকে আটক করে নিয়ে যেতেই নয়া ওসি আটককৃতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুম মামলা রুজুর জন্য চাপ সৃষ্টি করে। তাছাড়া নবনিযুক্ত ওসির ছোট ভাই একবার সেনা অভিযানকালে ফেন্সিডিলসহ আটক হয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই কারো কারো প্রতি তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ-অপছন্দ থাকতেই পারে। তবে মেজর সিনহা হত্যা মামলার ক্ষেত্রে তার সতর্ক আচরণ নিশ্চিত করতেও অভিমত দিয়েছেন অনেকে।

* কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কয়েকটি লাইনে আক্রান্ত ভুক্তভোগির বক্তব্য না থাকলে অবশ্যই তার প্রতি অবিচার করার অভিযোগ উঠতেই পারে। কিন্তু সহযোগী মিডিয়াগুলো যখন সেই ভুক্তভোগির একক বক্তব্য ফলাও করে প্রকাশ করেন তখন যে আরেকজনকে ভুক্তভোগী বানানো হয়- সেখানে ন্যায্যতা নিশ্চিত হয় কেমন করে ?

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page