মীর আলাউদ্দিন : তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় এবার বোরোর বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। বীজতলাগুলো সবুজ থেকে ক্রমেই হলুদ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আসন্ন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে সারাদেশের চাষী। প্রতিদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘন কুয়াশা বিরাজ করছে। মাঝরাতে ওই কুয়াশা বরফ শীতল হয়ে ঝরে পড়ছে। মাঝেমধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। পাশাপাশি দিনের অধিকাংশ সময়ই সূর্যের দেখা মিলছে না। এর প্রভাব পড়েছে বোরোর বীজতলাসহ চলতি রবিশস্যের ওপর। শীত মৌসুমের এই বিরূপ আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বোরোর বীজতলা। ফলে অনেক এলাকায় চাষীকে নতুন করে আবার বীজতলা তৈরির প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তাতে বোরো আবাদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কৃষকের শঙ্কা কাটাতে বীজতলা নিয়মিত পরিচর্যাসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছে। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষি কর্মকর্তারা কোল্ড ইনজুরি থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করছে। কিন্তু কুয়াশার তীব্রতা এতোটাই বেশি যে, ওসব পরামর্শ অনেক ক্ষেত্রেই কাজে আসছে না। দিন দিন বিবর্ণ ওনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজতলা। ফলে বীজ চারার সঙ্কটে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৫ লাখ টন চাল আকারে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেজন্য বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমি। ওই পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদ করতে হলে ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা প্রয়োজন। তবে কৃষকরা তার চেয়েও বেশি জমিতে বোরোর বীজতলা তৈরি করেছে। কিন্তু এবারের দীর্ঘস্থায়ী ঘন কুয়াশা ও শীত তাদের বিপাকে ফেলে দিয়েছে। ফলে এবছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে তারা শঙ্কিত। সূত্র জানায়, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার কুয়াশা বেশি। সাধারণত ঢাকা, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও যশোর অঞ্চলে ডিসেম্বরে গড়ে ২২ দিন মধ্যরাত থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত কুয়াশা থাকে। আর জানুয়ারিতে থাকে ২৩ দিন। এবছর ডিসেম্বরে ২৩ দিন কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। আর জানুয়ারির ১৬ দিনের মধ্যে ১৩ দিনই কুয়াশাচ্ছন্ন থেকেছে। দেশে প্রাকৃতিক কারণে কুয়াশা বাড়লেও ধোঁয়া ধুলায় তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে এবার দুই মাস ধরেই সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশা নেমে আসছে। আর ওই কুয়াশা স্থায়ী হচ্ছে সকাল পর্যন্ত। শৈত্যপ্রবাহের সময়ে বিকেল ৪টার পরই কুয়াশায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে সারাদেশ। আর রাত যতো গভীর হচ্ছে কুয়াশার তীব্রতাও ততো বাড়ছে। এবছর অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, ডিসেম্বর মাঝামাঝি টানা ৬ দিন উত্তরাঞ্চলে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।
সূত্র আরো জানায়, মূলত ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতার কারণেই এবার বোরোর বীজতলা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। এই অবস্থায় কৃষি বিভাগ থেকে কৃষককে রাতে বীজতলায় পানি দিতে এবং বীজচারা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া শীত ও কুয়াশা থেকে বীজ চারা রক্ষার জন্য সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করার জন্যও বলা হয়েছে। শীত বা কুয়াশা থেকে বোরো বীজতলা রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখা অথবা বীজতলায় সেচ দিয়ে চারাগাছের পাতা ও ডগা থেকে কুয়াশায় ঠা-া পানি ফেলে দিলে চারাগাছ বাঁচানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি বীজতলার চারার গোড়া বা পাতাপচা রোগ দেখা গেলে ব্যাভিস্টিন বা মেনকোজেব গ্রুপের যে কোনো একটি ছত্রাকনাশক প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আর যতোদিন শৈত্য প্রবাহ থাকে ততোদিন এ পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, যদি কোন বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয় তাহলে সেচ প্রদান এবং জিপসাম বা ইউরিয়া সার স্প্রের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা যায়। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করছেন, বিভিন্ন স্থানে বীজতলা পর্যবেক্ষণ করছেন। সেই সঙ্গে বীজতলা রক্ষায় কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। শীত ও কুয়াশা থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে নানা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশের সব জেলায় কৃষকদের মাঝে কোল্ড ইনজুরি থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য করণীয় সম্পর্কে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। আশা করা যায় কৃষক বীজতলার ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে এবং বোরো আবাদ ব্যাহত হবে না। সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।