আজ [bangla_date], [english_date]

সঞ্চয়পত্র: ৫ মাসে ২৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ

বিপাকে সরকার : ৫ মাসে ২৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ

নিজেস্ব প্রতিবেদক : সঞ্চয়পত্রের ‘অস্বাভাবিক’ বিক্রির মাশুল দিতে হচ্ছে এখন সরকারকে। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসলের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।তোদিন সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে সরকার উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটালেও এখন সেই সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধ করতেই চলে যাচ্ছে বিশাল অংকের অর্থ। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ সরকার গ্রাহকদের ২৩ হাজার ২১ কোটি টাকা শোধ করেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ বাবদ খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার ৩৭৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে এই পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশের মতো। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি থাকায় বাধ্য হয়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করছে এই দায়। আর এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সবমিলিয়ে ২৮ হাজার ৮৬২ কোটি ৯২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদই পরিশোধ করা হয়েছে ১২ হাজার ৮০৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ হিসাবে জুলাই-নভেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ৩৭ হাজার ৬০ কোটি টাকার মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ খরচ হয় ১৫ হাজার ৩৭৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নিট বিক্রি ২৭১ শতাংশ কমলেও সুদ-আসল পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি যেভাবে ‘লাফিয়ে লাফিয়ে’ বেড়েছিল; এখন ঠিক সেভাবেই ‘লাফিয়ে লাফিয়ে’ কমছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মাত্র ৩২০ কোটি ৬২ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১২ গুণ বেশি; ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। তার আগে অক্টোবরে ৮২৩ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বিক্রির পরিমাণ ছিল পাঁচ গুণেরও বেশি; চার হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৯৮৫ কোটি ৭১ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। তার আগের বছরের সেপ্টেম্বরে বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় চার গুণ বেশি; ৪ হাজার ৩৫৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দুই হাজার ১৬০ কোটি ১৭ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। দ্বিতীয় মাস অগাস্টে নিট বিক্রি কমে এক হাজার ৪৯৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় নেমে আসে। ২০১৮ সালের অগাস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল চার হাজার ২১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। করের হার বৃদ্ধি এবং কড়াকড়ি আরোপ করায় এভাবে প্রতি মাসেই কমছে সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ হিসেবে পরিচিত এ খাতের বিনিয়োগ। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে গত কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। বিক্রির চাপ কমাতে ১ জুলাই থেকে মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে কোনো সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না মর্মে শর্ত আরোপ করা হয়। ‘আর এ সব কারণেই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে’ জানিয়ে জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ মোটা অংকের অর্থ শোধ করতে গিয়ে সরকারকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। লাগাম টেনে না ধরে এতোদিন বেশি বেশি বিক্রির যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তার মাশুল দিতে হচ্ছে এখন।” তিনি বলেন, ব্যাংক আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হচ্ছিল। পুঁজিবাজারেও দীর্ঘদিন ধরে মন্দা চলছে। সব মিলিয়ে যাদের সঞ্চয় ছিল তারা ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রকেই বেছে নিয়েছিল। “কিন্তু করের হার বৃদ্ধির কারণে এখন কম মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সবাই।” “আগে মেয়াদ পূর্ণ হলে আসলটা ফের বিনিয়োগ করত। এখন মুনাফা কম আসায় পুনঃবিনিয়োগ করছেন না।” তবে ভবিষৎ ঋণের বোঝা কমাতে সরকারের এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা কমাতে ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়। তার আগে পাঁচ বছর মেয়াদি এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেতো। সুদের হার কমানোর ফলে পাওয়া যেতো ৯১২ টাকা। গত বছরের জুলাই মাস থেকে করের হার বাড়ানোয় পাওয়া যাচ্ছে ৮৬৪ টাকা। তবে পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ হলে প্রতি লাখে মাসে ৯১২ টাকাই মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম। এতোদিন সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হওয়ায় সেখান থেকে টাকা নিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতো। কিন্তু এবার বিক্রি কমায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রায় পুরোটা নেওয়া হয়ে গেছে পাঁচ মাসেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেলেছে।

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page

error: sorry please