আজ [bangla_date], [english_date]

পার্কগুলোতে নেই স্বস্তির সুবাতাস

নিজস্ব প্রতিনিধি : মেগাসিটি ঢাকার ফুসফুস হলো পার্ক। কর্মব্যস্ত মানুষ যান্ত্রিক শহরের আকাশচুম্বি দালান-কোঠার ভিড়ে দু’দন্ড স্বস্তির নিশ্বাস নিতে আর কিছুটা সময় খোলা আকাশের নিচে কাটানোর জন্য ছুটে যান সবুজে ঘেরা রমনা পার্কে, সোহরাওয়ার্দী, চন্দ্রিমা কিংবা ওসমানী উদ্যানে অথবা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে। কিন্তু এই উদ্যানগুলো নাগরিকদের কাছে এখন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। দখল আর অযতœ-অবহেলায় রাজধানীর বেশিরভাগ পার্কেরই অবস্থা এখন বেহাল। যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়, ছিনতাইকারী, হকার এবং টোকাইদের দৌরাত্ম্য, অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রবেশপথে নানা প্রতিবন্ধকতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশসহ অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে পার্কগুলো।

সিটি করপোরেশনের কাগজপত্রে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি শিশুপার্ক আছে। কিন্তু সশরীরে উপস্থিত হলে দেখা যাবে আসলে সেখানে পার্কের কোনো অস্তিত্বই নেই। যে জায়গায় একদা পার্ক ছিল সেখানে এখন বিরাজ করছে ক্ষুদ্র ও কাঁচামালের আড়ত, ব্যবসায়ী সমিতির মার্কেট। জানা যায়, একসময় শিশুপার্কটিতে বাচ্চাদের খেলাধুলা করার ব্যবস্থা ছিল, দোলনা ছিল। বেশ কিছু গাছপালাও ছিল। পার্কটির চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। পার্ক ভেঙে দোকান গড়ার কাজটি শুরু হয় ১৯৯১ সালের পর।
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র ও কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতি অবশ্য শিশুপার্কটির অস্তিত্ব স্বীকার করতেই নারাজ। তাদের দাবি, ২০০৩ সালে তারা ১১৮ জন আড়ত ব্যবসায়ী জায়গাটি যখন ইজারা নেন, তখনও এখানে কিছু দোকানপাট ছিল। তার আগে এটি ছিল পরিত্যক্ত একটি জায়গা। তাদের ইজারা অস্থায়ী হলেও এজন্য প্রতি বছর তাদের কাছ থেকে সিটি করপোরেশন রাজস্ব পেয়ে থাকে।

প্রায় দেড় কোটি মানুষের নগরী ঢাকায় পার্ক আছে মাত্র ৪৯টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২৩টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৬টি পার্ক রয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের মতে, ঢাকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পার্ক দখলদারদের কবলে। কারওয়ান বাজার শিশুপার্কের মতো কাগজে-কলমে এমন অনেক পার্ক রয়েছে, যেগুলোর ছবি তোলা হলে লিখে দিতে হবে- একদা এখানে একটি পার্ক ছিল। আসলে সিটি করপোরেশনের পার্কগুলো যেন কাজীর গরু; কাগজে আছে গোয়ালে নেই। দখল হয়ে যাওয়া এসব পার্কে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকান, ক্লিনিক, আড়ত, রেন্ট-এ কার স্ট্যান্ড, গাড়ির গ্যারেজ, মালপত্র রাখার গুদাম, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদি। বাকি সব পার্ক ঘিরেও চলছে দখলদারদের প্রতিযোগিতা।
তিনি আরও বলেন, দুই সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রিত ৪৯টি পার্ক ছাড়াও রাজউকের অধীন এক সময়কার মনোমুগ্ধকর রমনা, সোহরাওয়ার্দী ও চন্দ্রিমা উদ্যানও এখন অরক্ষিত প্রায়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কী পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে, তা করপোরেশন দুটি নিজেরাই জানে না। এই সম্পদ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসীনতা ও প্রশাসনিক স্থবিরতার কারণে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ২৬টি পার্কের অধিকাংশই স্থানীয় প্রভাবশালী মহল অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। এসব পার্কে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর কয়েকদিন না যেতেই আবার স্থানীয়রা সেখানে দোকান বসিয়ে দেয়। কোথাও কোথাও উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে নেই রায়েরবাজার শিশুপার্কটিও। পশু হাসপাতালের সামনের পার্কটির হদিস জানা নেই এলাকাবাসীর। লালবাগের রসুলবাগের পার্কটি পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। নয়াবাজারে নবাব সিরাজউদদৌলা পার্কের চারপাশ হয়ে গেছে বেদখল। মোহাম্মদপুরের শহীদ শাকিল পার্ক, শিয়া মসজিদ পার্ক, ইকবাল রোড মাঠ পার্ক, ফার্মগেট ত্রিকোণ পার্ক, শেরশাহ সূরি লেন পার্ক, তাজমহল রোড পার্ক, লালমাটিয়া ডি-ব্লক পার্ক, হুমায়ুন রোড পার্ক দখলদারদের কবলে চলে যাচ্ছে। আজিমপুর শিশুপার্কে বসেছে কাঁচামালের দোকান। কাগজে-কলমে মুক্তাঙ্গন পার্ক থাকলেও পার্কটিকে কেন্দ্র করে চলছে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা। মতিঝিলের দুটি পার্কেরই বেহাল দশা। মতিঝিলের এক নম্বর পার্কের পাশে একটি পুলিশ ক্যাম্প ও চারদিকে গ্রিল দেওয়া থাকলেও এর মধ্যেই চলছে অবৈধ কার পার্কিং, ভাতের হোটেল ও ভাসমান হকারদের দৌরাত্ম্য।

পান্থকুঞ্জ পার্কটির অবস্থা বড়ই করুণ। ত্রিভুজাকৃতির এই পার্কে সকালে প্রবীণেরা ব্যায়াম করতেন। বিকেলে অনেকে সবুজের ছোঁয়ায় সময় কাটাতেন। কিন্তু এখন আর সেই পরিবেশ নেই। ২০১৮ সালে পান্থকুঞ্জ পার্কটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। এরপরই রাজধানীর ব্যস্ততম সোনারগাঁও মোড়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এই পার্কের দুরবস্থার শুরু। দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ পার্কটির আধুনিকায়নে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে চারদিকে টিন দিয়ে এটিকে ঘিরে ফেলে। পরিকল্পনা ছিল এক বছরের মাথায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু কাজ শুরুর কয়েক দিন পর দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, পার্কের এক পাশে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক প্রকল্পের দুই থেকে তিনটি খুঁটি বসতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয় উন্নয়নকাজ।

এভাবে প্রায় তিন বছর পার হলেও এখনো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পান্থকুঞ্জ পার্ক এলাকায় শুরুই হয়নি। দক্ষিণ সিটিও পার্কটি জনসাধারণকে ব্যবহার করতে দেয়নি। এখন সেখানে চলছে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা এটিকে ‘ডেরা’ হিসেবে ব্যবহার করছে। পার্কটির চারপাশের কিছুকিছু জায়গায় এখন আর টিন নেই। চাইলেই যে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে। তবে ভেতরে হাঁটার মতো পরিবেশ নেই। কোথাও কোথাও গর্ত করে রাখা হয়েছে। গর্তে জমে আছে পানি। পোকামাকড় গিজগিজ করছে। জন্মেছে আগাছা। জঙ্গলের মতো হয়ে গেছে। কিছু জায়গায় পাথরের স্তূপ। স্থানীয় লোকজন জানান, ভরদুপুরেও পার্কটিতে ঢুকলে গা শিউরে ওঠে।  সূর্য ওঠার আগেই রমনা পার্কের সকাল শুরু হয় কেডস কিংবা ক্যাম্বিসের জুতো চাপিয়ে হাটতে আসা প্রান্তঃজনের পদচারণায়। দুপুর থেকে বিকেল কাটে নিরবতার চরম উদাসীনতায়। এ সময় কখনও ঘাসের বুকে কখনও কংক্রিটের চেয়ারে প্রেমিকযুগল হারিয়ে যায় রোমান্টিক প্ররোচনায়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা রমনা যেন হারিয়ে যায় ভয়ানক ব্যস্ততায়। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন ব্যস্তময় জীবনে প্রশান্তি খুঁজে ফেরা মানুষ। কেউ কেউ ক্রিকেট-ফুটবল নিয়ে সময় কাটান। সেইসঙ্গে পাখিও নীড়ে ফেরার উচ্ছ্বাসে কিচিরমিচির শব্দে মাতিয়ে তোলে জনারণ্যে মুখরিত রমনার অঙ্গন। এত নৈসর্গিক রূপের মাঝেও রমনা নানা সমস্যার জর্জরিত। এর দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে দুটি প্রবেশ পথ থাকলেও পূর্ব পাশের প্রবেশ পথটি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। এতে দর্শনার্থীরা বিড়ম্বনার শিকার হন। পার্কটিতে উদ্বাস্তুদের আনাগোনা চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। এ সময় এদের অনেকে গাঁজা, হিরোইনসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য সেবন ও সরবরাহ করে। আপত্তিকর ঘটনা ঘটলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী না থাকায় সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ অধিকাংশ দর্শনার্থীর।

ওসমানী উদ্যান ও গুলশান সেন্ট্রাল পার্কঃ উদ্যান নাকি খেলার মাঠ বোঝাই মুশকিল। বাইরে থেকে অসংখ্য গাছগাছালি দেখা গেলেও ভেতরের চিত্র ভিন্ন। গাছের ফাঁকে ফাঁকে খালি জায়গায় খেলাধুলা করে বহিরাগত ছেলেরা। তাদের খেলাধুলা ও ছোটাছুটিতে প্রতিনিয়ত অনেক গাছ নষ্ট হচ্ছে। হয়ে গেছে। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় চিপস, বিস্কুট ও চানাচুরের প্যাকেটসহ অসংখ্য ময়লা-আবর্জনা। ডাস্টবিন ভরে আছে আবর্জনায়। রয়েছে অসংখ্য ভবঘুরের আবাসস্থল, ভাসমান হকার। রাতে এ উদ্যান হয়ে যায় নিষিদ্ধ কার্যকলাপের আখড়া, মাদক সেবনও চলে হরদম। ফলে প্রয়োজন হলেও নিরীহ কেউ এদিকে পা বাড়ান না। ওসমানী উদ্যানটি প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়-সংলগ্ন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের ঠিক বিপরীতে। এ উদ্যানটির রক্ষকও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে রক্ষক হিসেবে থাকলেও নজরদারি নেই কর্তৃপক্ষের। একই অবস্থা গুলাশান সেন্ট্রাল পার্কের। এখানে ময়লা-আবর্জনা না থাকলেও চলছে হরদম খেলাধুলা। পার্কের ভেতরে নেই বসার জায়গা, নেই পর্যাপ্ত গাছও। সংরক্ষণেও নেই ব্যবস্থা। এ পার্কটি সম্পত্তি সূত্রে নিয়ন্ত্রণ করে

এটি গুলিস্তানের হকার্স মার্কেটের পূর্ব ও বঙ্গভবনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। পার্কটির চারপাশে ইটের দেয়াল ও মূল গেট বন্ধ থাকলেও ভেতরে অসংখ্য মানুষ হাঁটাচলা করে। ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষের আবাস্থল। কেউ রান্নাবান্না করছেন, আবার কেউ বসে বসে গাঁজা ও সিগারেট পান করছেন। পার্কের ভেতরের চারপাশ বিভিন্ন ফলের খোসা ও পলিথিনে ভরপুর। সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার হলেও এসব আবর্জনা পরিষ্কার করা হয় না।  এই পার্কটি বিমান অফিসসংলগ্ন। পার্কটির পরিসর কম হলেও ভেতরে গাছগাছালি। তবে পুরোটাজুড়ে রয়েছে হোটেলসহ অসংখ্য দোকান। ময়লা-আবর্জনারও কমতি নেই পার্কটিতে।

ফার্মগেট ত্রিকোন পার্কঃ এ পার্কের দক্ষিণ পাশে আবর্জনার স্তূপ। পলিথিন, বিস্কুট ও চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন ময়লা জমে আছে। সন্ধ্যা হলে পার্কের ভেতর বাড়তে থাকে ভাসমান লোকের আড্ডা। চলে মাদক সেবনসহ নানা অপ্রীতিকর কাজ। রাত রাড়লে ছিন্নমূল মানুষেরা শোয় এখানে। এ ছাড়া পার্কের পশ্চিমাংশে রয়েছে ওয়াসার পানির পাম্প ও সিটি করপোরেশনের পাবলিক টয়লেট। ভেতরে বসানো হয়েছে চা, পান-সিগারেটের দোকান।
শহীদ পার্কঃ পার্ক হিসেবে সিটি করপোরেশনের কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে মিল নেই। পার্ক হিসেবে থাকলেও দেখা যায় খোলা মাঠ। মাঠের মূল গেট বন্ধ থাকলেও ভেতরে ছেলেরা খেলাধুলা করে। পশ্চিম দেয়ালঘেঁষে গড়ে উঠছে ফার্নিচারের দোকান।
তাজমহল রোড পার্কঃ এই পার্কটির আয়তন শূন্য দশমিক ৬১। পরিমাণে ছোট হলেও ছোট-বড়  অসংখ্য গাছগাছালিতে ভরপুর। পার্কটিতে হাঁটাচলা ও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ক্লাব ও স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ পার্কটির প্রায় অর্ধেক জায়গা দখল করে ফেলেছে। এ ছাড়া চিপস, চানাচুর ও বিস্কুটের প্যাকেটসহ গাছের পাতায় পার্কের অবস্থা শোচনীয়।

এ ছাড়া হুমায়ুন রোড পার্ক, শিয়া মসজিদ পার্ক ও লালমাটিয়া ডি ব্লক পার্কের অবস্থা একই। দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো পার্ক। পার্কের ভেতর দিন-দুপুরে চলে খেলাধুলা। বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন দখল করে রাখছে এই পার্কগুলো।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের ভাষ্য, একটি আদর্শ নগরের বাসিন্দাদের জন্য ওই নগরের আয়তনের ১০ শতাংশ খোলা ময়দান ও পার্ক প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে রাজধানী ঢাকার জন্য রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। যা-ও কয়েকটা আছে, তা-ও আবার দখল ও দূষণের শিকার।

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page