আজ [bangla_date], [english_date]

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষফল ভোগ করছে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিনিধি : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। দেশটির লাখ লাখ নাগরিক নানা সময়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অনেক অংশ ডুবে যাওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া নারীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বৈষম্যমূলক প্রভাব সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে খর্ব করে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কারা দায়ী এটা সবাই জানে। মূলত ধনী দেশগুলো দায়ী। তাদের জনসংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ ৫ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে এরা ২২ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ধনী দেশগুলো দায়ী হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশকে বছরে ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

জোর দেয়া হচ্ছে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে নেয়া কার্যক্রমে। উন্নত দেশগুলো লক্ষ্য অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারলেও পিছিয়ে রয়েছে অনুন্নত দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে দেশগুলোর সামনে অন্যতম বড় বাধা পর্বতসম ঋণের বোঝা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরিদ্র দেশগুলোর বাজেটের বড় একটি অংশই চলে যায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে। এরপর দেশগুলোর পক্ষে জলবায়ু সম্পর্কিত কার্যক্রমে ব্যয় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। দারিদ্র বিমোচনে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার চেয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলো ঋণ পরিশোধে পাঁচগুণ বেশি ব্যয় করে। জুবিলি ডেট ক্যাম্পেইনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ৩৪টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বছরে ৫৪০ কোটি ডলার ব্যয় করছে। যেখানে ঋণ পরিশোধে এ দেশগুলোর ব্যয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার। উগান্ডার ঘোষণা অনুযায়ী, জলবায়ু সম্পর্কিত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০১৬-২০ সালের মধ্যে দেশটির জলবায়ু প্রকল্পগুলোয় ৫৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যয় করার কথা ছিল। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের তহবিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার দেশটি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেই বার্ষিক বাজেটের বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় করে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ দেশটির মোট ঋণের বোঝা ৭৩ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ১৩৫ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। তবে উগান্ডা একমাত্র নিম্ন আয়ের দেশ নয়, যারা ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত নগদ অর্থের সন্ধান করছে। জুবিলি ডেবট ক্যাম্পেইনের প্রাক্কলন, ২০২৫ সালের মধ্যে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৩৪টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সীমিত করার চেয়ে ঋণ পরিশোধে সাতগুণ বেশি ব্যয় করবে।

দাতব্য সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হাইডি চাও বলেন, চলতি সপ্তাহের শেষে গ্লাসগোয় কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানে নিম্ন আয়ের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তাদের সক্ষমতার ওপর ঋণের প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরবে। দেশগুলো এমন একসময়ে ধনী দেশ, ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে কোটি কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধের প্রভাবটি তুলে ধরছে, যখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দেশগুলোর বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন। তিনি বলেন, অনুদানের মাধ্যমে জলবায়ু তহবিল সরবরাহের পাশাপাশি ঋণও বাতিল করতে হবে। গত ২০ বছরে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) ঋণদানকারী সংস্থাগুলো উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে ব্যাংকঋণ ও বন্ড ব্যবহার করে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে উৎসাহিত করছে। ঋণগ্রহীতারা আশা করেছিলেন, নিয়মিত ঋণ পরিশোধে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদের হার কমতে থাকবে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলো এখনো নিয়মিতভাবে ঋণের ওপর ১০ শতাংশেরও বেশি হারে সুদ দিয়ে থাকে। যেখানে ধনী দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ সুদের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। দাতব্য সংস্থাটি ৩৪টি দেশের ঋণ পরিশোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে সরবরাহ করা বাজেটের প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা করেছে। সেখানে আন্তর্জাতিক তহবিল পেলে দেশগুলো কীভাবে ব্যয় করবে এবং তাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করবে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

উগান্ডায় অবস্থিত সাউদার্ন অ্যান্ড ইস্টার্ন আফ্রিকা ট্রেড ইনফরমেশন অ্যান্ড নেগোসিয়েশন ইনস্টিটিউটের আউসি কিবোয়া বলেন, ঋণ সংকট নিয়ে উগান্ডার ওপর প্রচ- চাপ রয়েছে। সুতরাং দেশটির সরকারের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় দরিদ্র দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার অনুদান সরবরাহের লক্ষ্য ছিল ধনী দেশগুলোর। তবে প্রতিশ্রুতির প্রথম বছর ২০২০ সালে সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের আগে এ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশও বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে যে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কথা সেটি পাচ্ছে না। বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে জলবায়ু অর্থায়ন আরও কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রফেসর ড. মিজান আর খান। তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়নের ৮৫ ভাগ বরাদ্দ আসে স্থানীয় খাত থেকে তাই স্থানীয় খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে।

একই সঙ্গে নিজেদের টাকা কীভাবে খরচ হচ্ছে তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে হবে। ন্যাশনাল এডাপটেশন প্লান স্থানীয় ও আঞ্চলিকভিত্তিতে বাস্তবায়ন করাই সমীচীন। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে বলেও তিনি জানান। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে তাই লস অ্যান্ড ডেমেজ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। তাছাড়া  দেশের জনমিতির লভ্যাংশকে কাজে লাগানোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার যুব সমাজকে প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধম্যে জনশক্তি রপ্তানি করা যেতে পারে বলে অভিমত দেন। পাশাপাশি সুশীল সমাজকে এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। ৪৮টি দেশের ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রতিনিধিত্ব করা মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, অনেক দেশ বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু সুরক্ষায় অর্থ ব্যয় করতে গেলে আমাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করাও সম্ভব নয়। তাহলে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য ঋণ পুনর্গঠনের আহ্বান জানানো কি যুক্তিযুক্ত নয়?

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page