আজ [bangla_date], [english_date]

‘চাই সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক সাংবাদিকতা’

সাঈদুর রহমান রিমন : (১ মে থেকে শুরু হচ্ছে জাতীয় গণমাধ্যম সপ্তাহ, ২০২১। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ) টানা পাঁচ বছর যাবত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম সপ্তাহ পালন করে আসছে। বিএমএসএফ বরাবরই গণমাধ্যম সপ্তাহের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়। এ ব্যাপারে সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের কোনো দ্বিমত নেই-তবুও কেন স্বীকৃতি প্রদানের দীর্ঘসূত্রিতা? কারণ অজ্ঞাত কিংবা কেবলই অবহেলাজনিত। আমরা বিলম্বে জাতীয় গণমাধ্যম সপ্তাহের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করছি।)

বিভিন্ন আকারের, হরেক নামের হাজারো পত্রিকা প্রকাশনার দেশ-বাংলাদেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য অনলাইন পোর্টাল, টোয়েন্টি ফোর ডট কম, আইপি টিভি লাইফের ছড়াছড়ি। পাশাপাশি আছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ভিত্তিক গুজব খবরের নানা আয়োজন। বাস্তবেই নানা জৌলুসতা, নিত্য নতুন প্রযুক্তির সংযুক্তি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাবে সাংবাদিকতা এখন অভিজাত হয়ে উঠেছে, কিন্তু আসল সাংবাদিকতা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। শুধু তাই নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন সাংবাদিকতার কারণে ক্রমেই আমরা বৃহত্তর সমাজ ও জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীও সাংবাদিকদের সমাজচ্যুত প্রাণী হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। আসলেই কী আমরা বিচ্ছিন্ন দল-উপদলের সদস্য হিসেবেই বেচে আছি? সম্ভবত এ কারণেই ঘন ঘন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হলেও সার্বজনীন কোনো প্রতিবাদ হয় না। আমার ধারনা-বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষ অতি প্রয়োজনে সাংবাদিকদের কাছে এগিয়ে আসেন এবং কাজ হাসিল করেই সটকে পড়েন, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেন তারা। তাদের কাছে সাংবাদিকরা মূলত ‘বিপজ্জনক প্রাণী’ হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছেন। নিরাপদ দূরত্বে না থেকেই বা করবেটা কী?

ভূয়ারাই বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিনত করেছে
ভূয়া ভন্ড শ্রেণীর সাংবাদিক সম্পাদকদের ঘৃণ্য সব কর্মকান্ডই মূলত সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে বৃহত্তর সমাজ, জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছেড়েছে। খোদ রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়েও যত শ্রেণীর সাংবাদিক আছেন-তাদের বেশিরভাগই তান্ডব সৃষ্টিকারী। ভূয়া সাংবাদিক, ফেসবুক সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, দলবাজ সাংবাদিক, টোয়েন্টিফোর ডট কম মার্কার সাংবাদিক- সম্পাদক, আইপি টিভি, ফেসবুক লাইভ সাংবাদিক…আরো কত শত পদ পদবীর সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ। জনস্বার্থ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নিয়ে এসব সাংবাদিকের চিন্তা ভাবনার সুযোগটা কোথায়? দিনরাত উন্মাদের মতো ছোটাছুটির মধ্যেই অবিরাম তাদের ধান্ধাবাজি চালাতে হয়। তাদের যাঁতায় বৃহত্তর সমাজ, প্রশাসন, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সংগঠক সবাই পিস্ট হন প্রতিনিয়ত। বুদ্ধিমান, সম্মানীতরা এ শ্রেণী থেকে পালিয়ে থাকাটাই নিরাপদ ভাবে। কে আসল, কে নকল, কে ভূয়া তা নিয়ে যাচাই বাছাই করার মতো পন্ডশ্রম দেয়ার সময় তাদের নেই। তারা মাঝে মধ্যে বিণয়ের সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন: র্যাবের হাতে ভূয়া র্যাব ধরা পড়ে, ডিবির হাত থেকে ভূয়া ডিবির গ্রুপও নিস্তার পায় না। কিন্তু ভূয়া সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, প্রতারক সাংবাদিক দমনে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক সংগঠনগুলোর দায়িতটা কি? মহান পেশাটির স্বচ্ছতা ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সরকারের কী কোনো ভূমিকা নেই?

‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোর্টাল-প্রত্যেকেই এডিটর’
এ তো গেল সাংবাদিকদের ব্যাপার! এবার সংবাদপত্রের বিষয়ও একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। দেশে মূলত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও প্রচার মাধ্যম- এই তিন ধরনের সংবাদ সরবরাহকারী মাধ্যম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং যার যেমন খুশি তেমনভাবে তৈরি করা টোয়েন্টিফোর ডট কম যুক্ত রঙ বেরঙের কথিত নিউজ পোর্টালগুলো রীতিমত ভয়ঙ্কর রুপে আবির্ভূত হয়েছে। এ ক্ষেত্রটিতে যেন ইরি ধানের মতোই বিপ্লব ঘটে চলেছে। ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোর্টাল-প্রত্যেকেই এডিটর’ এমন স্লোগানকে আদর্শ বানিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়াড় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক নিউজ পোর্টালগুলো সবার কাছেই আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোতে সকালে একজনের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়তো দুপুরেই অন্যজনের সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়, আবার সন্ধ্যা না পেরোতেই চিহ্নিত সিঁধেল চোরাকে বানিয়ে দেয়া হয় সাদা মনের মানুষ। কোনো কোনো পোর্টাল প্রতিষ্ঠাতা প্রতিদিন তার রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে প্রধান স্টোরি বানালেও তার স্ত্রী তুলে ধরেন নিজের বিউটি পার্লারের হরেক গুণাগুণের কাহিনী। অন্যদিকে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির নতুন প্রেমে পড়ার ধকলযুক্ত ছড়া-কবিতায় আধা পাতা পূর্ণ করা হয়। আর ফেসবুক স্ট্যাটাসের নামে যেসব জঘণ্য মূর্খতার ছড়াছড়ি চলে তা দেখলেই ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠে।

গণমাধ্যম না কি প্রচারমাধ্যম?
এছাড়া বাজারে চলমান পত্রিকা ও দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখে শুনে বারবারই পাঠক, দর্শক- শ্রোতারা হকচকিয়ে উঠেন। কোনটা যে প্রচার মাধ্যম আর কোনটা যে গণমাধ্যম তা বুঝে ওঠাও কষ্টকর। তবে ধনপতি কারখানা মালিকদের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকান্ড ঘটলেই তাদের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াগুলো যে কী ধরনের ‘প্রচার মাধ্যম’ তা টের পাওয়া যায়। রাজনীতিবিদ এবং সরকারগুলো বরাবরই যেমন জনগণের দোহাই দিয়ে গণবিরোধী অপকর্ম চালিয়ে থাকে-তার চেয়েও জঘণ্যতায় চলে গণমাধ্যম নামের প্রচার মাধ্যমগুলো। মনে রাখা দরকার প্রচার মাধ্যমের লিফলেট আর ভিডিওগুলোতে গণমানুষের ঠাঁই নেই- সেখানে থাকে নিজের ও সমমনা কারখানাসহ ব্যবসা বাণিজ্যের ‘বিজ্ঞাপনী নিউজ।’ অথচ সাধারণ জনগণের কথা লিখতে গিয়ে প্রকৃত গণমাধ্যম নানা ধকলে নি:স্ব হয়, তালা ঝুলে সদর দরজায়। দৈনিক অধিবেশনের প্রেসসহ বিক্রি করে ঝিনাইদহ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয় আলী কদর পলাশদের। নারায়নগঞ্জের জনতার মুখপত্র যুগেরবাণী’র প্রিন্ট করা নিষিদ্ধ করার পর অনলাইন এডিশনও বন্ধে বাধ্য করা হয়। আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক সুশান্তকে জেলে ঢুকিয়েও সাংবাদিক পোশাকধারী দালালচক্র স্বস্তি পায় না, পত্রিকাটির অনুমোদনপত্র বাতিলের জন্যও নানা কাঠখড় পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। আরো কত কী….

অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষীণ আর্তনাদ
সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের পেশা, দায়িত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈ কি! সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষার ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে আসলেই আমরা কতটুকু দায়িত্ববোধের পরিচয় দিচ্ছি। সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সংবাদ তৈরি আর প্রকাশ নিজেদের পেশার শুদ্ধতা বজায় রাখতে কতটুকু ভূমিকা রাখছি আমরা? সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সাংবাদিকতাকে আরো শাণিত করা, বাস্তবমুখিতে রুপান্তর করা দরকার কি না তা ভেবে দেখা খুবই জরুরি। আমরা কী জনদুর্ভোগ লাঘবে সাংবাদিকতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি? বৈষম্য ও বঞ্চণার বিরুদ্ধে যথাযথ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে আমরা কী জনমত সৃষ্টি করে বৈষম্য বঞ্চণা নিরসনে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারছি? পারিনি। বরং গত কয়েক বছর যাবত কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রচারিত নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধেই জনমত গড়ে উঠেছে, সেসব ব্যাপারেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাহলে ঘোষিত গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকতা কী জনকল্যাণে যথাযথ ভূমিকা রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে? বোধকরি তাই। আমরা পেশাদারিত্বের ব্যাপারে হয়তো অঙ্গিকারাবদ্ধ নই, জনস্বার্থের চেয়েও স্বীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতেই হয়তো বেশি উৎসাহী থাকি। জনস্বার্থ বিষয়ক চাওয়া পাওয়া তুলে ধরে তা সমাধানের ক্ষেত্রে পেছনে লেগে থাকার দায়বোধ থাকে না আমাদের। সেটুকু নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তথা রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকা সম্ভব বলে মনে করি।

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page