আজ [bangla_date], [english_date]

ধারাবাহিক প্রতিবেদন - ১

করোনা দুর্যোগেও এমপি দুর্জয়ের বেপরোয়া দখল বাণিজ্য

* গড়ে উঠেছে চাচা-ভাতিজার দুর্বৃত্ত বাহিনী

* নির্বাচনী এলাকায় দুর্ণামের ছড়াছড়ি

‌বি‌শেষ প্র‌তি‌নি‌ধি : করোনা দুর্যোগে গোটা দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও এমপি দুর্জয়ের দখল বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না কোনভাবেই। এমপির চাচা তায়েবুর রহমান টিপুর নেতৃত্বে গড়ে তোলা চক্র একের পর এক জায়গা জমি দখলবাজিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ চক্রের আগ্রাসী থাবা থেকে নদী-নালা, সরকারি খাল, টার্মিনাল, রাস্তা থেকে শুরু করে সাধারন মানুষের ভিটে বাড়ি, ফসলী জমি কোনকিছুই রক্ষা পাচ্ছে না। নির্বিঘ্নে সবকিছুই গিলে খাচ্ছেন চাচা-ভাতিজার গ্রুপ। অতিসম্প্রতি চক্রটির সর্বশেষ থাবা পড়েছে আরিচা নৌ-টার্মিনালের বহুদামি সরকারি সম্পত্তিতে। ঈদের আগে এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় যখন দলবল নিয়ে যমুনার চরে ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত ছিলেন ঠিক তখনই তার চাচার গ্রুপ আরিচা নৌ-টার্মিনালের বহুদামী জায়গাটা পুরোপুরি জবর দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্যে বিআইডব্লিউটিএ‘র বেদখল হওয়া এ জায়গার দাম অন্তত সাড়ে তিন কোটি টাকা বলে জানা গেছে। এর আগেও এমপির গনসংযোগ কিংবা জনসভাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের অভিনব কৌশলে দৌলতপুর উপজেলা সদরে ও ঘিওর হাটের বেশ কয়েকটি জায়গা দখলবাজিরও ঘটনাও ঘটায় চক্রটি।

মানিকগঞ্জ-১ (দৌলতপুর, ঘিওর ও শিবালয়) আসনে সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয় সরকারি দলের টিকিটে পর পর দুই বার এমপি নির্বাচিত হওয়ায় তার চাচার গ্রুপটি ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নানারকম সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে শুরু করে চঁাদাবাজি, দখলবাজিসহ পেশীশক্তির বলে এলাকা এমনকি সরকারদলীয় রাজনীতিকেও একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করারও সাহস কারো নেই।

স্থানীয় সূত্র মতে, মানিকগঞ্জ-১ আসনভুক্ত দৌলতপুর, ঘিওর ও শিবালয় উপজেলার বিভিন্ন জনপদকে রীতিমত ভীতসন্ত্রস্ত এলাকায় পরিনত করেছে চক্রটি। সেসব এলাকায় মানুষের দিন-রাত কাটে অজানা আশঙ্কায়। কখন বুঝিবা টিপু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা হামলে পড়ে, কার না কার বাড়িঘর, ফসলি জমি, দোকানপাট জবর দখল করে তার ইয়োত্তা নেই। জানা গেছে, গত এক বছরে দৌলতপুর উপজেলা সদর বাজারে সরকারি খালসহ জায়গা, নিরীহ লোকজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে বড় বড় আয়তনের একাধিক পাকা মার্কেট নির্মাণ করেছে সংঘবদ্ধ এই দখলবাজ চক্র। কেউ প্রতিবাদ করলেই ‘এমপির নির্দেশ আছে’ বলে সবাইকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। দখল করা এসব মার্কেটের দোকানপাট এককালীন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে লিজ দেওয়ার নামেও চলছে আরেক রকম প্রতারণার বাণিজ্য।

এদিকে সরকারি খাল ভরাটের পর মার্কেট নির্মাণ করে পজিশন দেওয়ার নামে অর্থ নেওয়া হলেও তা ক্রেতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এমপি দুর্জয়ের নির্দেশে সরকারি খাল ভরাট করা হয়। পরে জৈন্তা গ্রামের মো. আমিনুর রহমান, সমেতপুর গ্রামের জুলফিকার হোসেন, মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ারা দোলেন, তার বোন জামাই চান্দু মিয়া, ছোট বোন স্কুলশিক্ষিকা খুদেজা বেগম, কাকা আজাদ হোসেন, আলতাফ হোসেন, শহিদুল ইসলাম শহিদ, আমোদ আলী, আবদুল হালিম, শুবোত মিয়াসহ আরো ১০-১৫ জন থেকে চাহিদামাফিক টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হয়। দখলবাজচক্রের অন্যতম সদস্য চেয়ারম্যান মোশারফ ও ভিপি আলমগীর হোসেন আলম এসব ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা উঠিয়ে এমপির চাচা তায়েবুর রহমান টিপুর হাতে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ক্রেতারা দোকানের পজিশন বুঝে পাচ্ছেন না, ফেরত পাচ্ছেন না জামানতের টাকাও। বরং টাকা ফেরত চাওয়ায় ভুক্তভোগীরা নানারকম হুমকি-ধমকির মুখে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন।

এসব ব্যাপারে এমপি দুর্জয়ের ঘনিষ্ঠজন খ্যাত মোশাররফ চেয়ারম্যান ও ভিপি আলমগীর হোসেন আলম বলেন, ‘এমপি সাহেবের নির্দেশে পকেটের টাকা খরচ করে সরকারি হজামজা খালটি ভরাট করি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাল ভরাটকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।‘ পজেশন বরাদ্দের নামে অগ্রিম কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে তারা জানান, দলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতাকর্মি খাল ভরাটের জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ করে টাকা করে অগ্রিম দিয়েছেন। প্রশাসনিক জটিলতা শেষ হলে তাদেরকে দোকানের পজিশন বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

দুর্জয় এমপিকে ঘিরে দূর্ণামের ছড়াছড়ি

জাতীয় দলের ক্রীকেট অধিনায়ক হিসেবে দেশবাসীর ভালবাসায় সিক্ত এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে চরম বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন। চঁাদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির হাজারো অভিযোগ ঘিরে আছে তাকে। দুর্জয়ের নির্বাচনী এলাকা মানিকগঞ্জ-১ আসনভুক্ত দৌলতপুর, ঘিওর ও শিবালয় উপজেলা জনপদে মানুষের মুখে মুখে তার দূর্ণামের ছড়াছড়ি। পার্সেন্টেজ বাণিজ্যেরও শীর্ষে রয়েছে এমপি দুর্জয়ের নাম। স্কুলের নাইট গার্ড নিয়োগ থেকে টিআর, কাবিখা ও সোলার প্যানেল বরাদ্দের সর্বত্রই চাহিদা মাফিক টাকা গুণে দিতে হচ্ছে। এসব টাকা যথাসময়ে তুলতে এমপি’র তিন খলিফা সদায় ব্যস্ত থাকেন। মানিকগঞ্জের প্রবীণ ও ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতাদের অনেকেই এমপি ও তার দলবলের নানা অপকর্মে রীতিমত বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাদের ভাষায়: ব্যাট হাতে কয়েকশ’ ফুট আয়তনের ক্রিকেট মাঠ চিনলেও কয়েকশ’ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের নিজ সংসদীয় এলাকার সঙ্গে তার খুব একটা চেনাজানা নেই। আওয়ামীলীগের দুই দফা সরকারে নৌকার জোরে এমপি হলেও দুর্জয় এ পর্যন্ত ৩২টি গ্রামে পা রেখেছেন। বাকি ১৫৭টি গ্রাম তিনি চিনেনও না। সপ্তাহে বা মাসে একদিন এলেও তিনি বড়জোর জেলা প্রশাসনে ওঠাবসা আর সার্কিট হাউজে পা রেখেই ফিরে যান ঢাকায়।

নদী ভাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত এলাকাবাসীর অভিযোগ হচ্ছে, সাংবাৎসরিক ‘দুর্জয় গজবে’ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। নদ-নদীতে সারাবছর পরিচালিত বেপরোয়া ড্রেজিং কর্মকান্ডকেই ভুক্তভোগী বাসিন্দারা দুর্জয়ের গজব হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সকল নদ-নদীতে বেপরোয়া ড্রেজিং করে বেশুমার বালু উত্তোলন। মাসিক ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এমপি’র নির্দেশনায় চলে ড্রেজারগুলো। রাত দিন যত্রতত্র এসব ড্রেজিংয়ের দৌরাত্ম্যে বহু বাড়ছে।

Comments are closed.

     More News Of This Category

follow us on facebook page