নিজেস্ব প্রতিনিধি : এখন থেকে বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে সব ধরনের পণ্য রেলকার্গোতে আমদানি করতে পারবে। কিছু শর্ত সাপেক্ষে সব ধরনের পণ্য ভারত থেকে সাইডডোর (পাশে দরজা বিশিষ্ট) রেলকার্গোর মাধ্যমে আনার অনুমতি দেয়া হয়। করোনা সংক্রমণকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভারতীয় আমদানি পণ্য চালানে বেনাপোলে রেলকার্গো হ্যান্ডলিংয়ের অনুমতি দিয়েছে। ফলে আমদানি পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য কমার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সময়ও সাশ্রয় ও খরচ কমবে। যদিও স্বাধীনতার পর কিছুদিন রেলকার্গোতে ভারতীয় পণ্য বেনাপোলে এসেছে। তারপর বেনাপোলে রেলকার্গো হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে যায়। তবে করোনাকালে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর বন্ধ থাকায় সম্প্রতি চাল, গম, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনা ঝাল ও ফ্লাই অ্যাশের চালান রেলওয়াগনে এদেশে আসে। এখন দেশের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের চালান রেলে আনতে আগ্রহী। কাস্টমস এবং বেনাপোল বন্দরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে জড়িতদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলকার্গোর মাধ্যমে পণ্য আমদানির নানাবিধ সুবিধা রয়েছে। ট্রেন আগমন থেকে ছেড়ে যাবার লিডটাইম ন্যূনতম এক-পঞ্চমাংশ। এক ওয়াগন ৪ ট্রাকের সমান পণ্য আনা যাবে। রেলকার্গোতে মিথ্যা ঘোষণার সুযোগ কম। ট্রেনে ভাড়া ট্রাকের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। আবশ্যিক পার্কিং, ট্রাকের দীর্ঘসময় অপেক্ষা ও চাঁদা নেই। দিনে ১০০ বগির একটি ট্রেনে ৪০০ ট্রাকের পণ্য আনা যাবে। তাছাড়া রেলকার্গোতে অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে মিথ্যা, অপঘোষণা, চোরাচালানের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর পণ্য বোঝাই সরকারি ও খোলা জায়গায় হয়। কিন্তু ট্রাকে আনা বাণিজ্যিক পণ্যের ক্রেতা, সিএন্ডএফ, ট্রাকের, বন্দরের, কাস্টমসের, সরকারি-বেসরকারি অনেককে পাহারা দিতে হবে না। ফলে বেনাপোল স্থলবন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে। কাস্টমস ও বন্দরে বাড়তি লোকবল ছাড়াই দ্বিগুণ পণ্য ছাড় করতে পারবে। শুল্কায়ন ও খালাস কয়েকদিনের পরিবর্তে কয়েক ঘন্টায় হবে। এর ফলে আমদানি পণ্য কম সময়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছে যাবে। সূত্র জানায়, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ২২ মার্চ থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। পরে দু’দেশের উর্ধ্বতন মহল ও বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের কয়েক দফা বৈঠকে আমদানি-রপ্তানি চালু করার নির্দেশনা দিয়েও চালু করা যায়নি। এর পেছনে বনগাঁ ও পেট্রাপোলে ট্রাক থেকে চাঁদাবাজিকে দায়ি করা হয়। এমনকি গুজব ছড়ানো হয় বেনাপোল দিয়ে প্রচুর করোনা রোগী সেদেশে প্রবেশ করছে এবং বেনাপোলে অনেকে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বশেষ বেনাপোল কাস্টম রেলকার্গোতে ধানবীজের একটি চালান ১০ মিনিটে শুল্কায়ন করে রেকর্ড করে। বিষয়টি এনবিআরসহ বিভিন্ন মহলের দৃষ্টিতে আসে। এমন পরিস্থিতিতে রেলকার্গোতে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দিতে বেনাপোল কাস্টম হাউস বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরকে চিঠি দেয়। আর ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশ অনুরোধ জানায়। তারই প্রেক্ষিতে এনবিআর এ অনুমতি দিয়েছে। সূত্র আরো জানায়, বিগত ৪ মে কোভিড-১৯ সংক্রমনকালীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রেলপথে পরিবহনের বিষয়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সঙ্গে একটি ভিডিও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে রেলপথে সকল ধরনের পণ্য আমদানিতে সহায়তার অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি পরীক্ষা করে মতামত প্রদানের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি কয়েকটি সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। সুপারিশের মধ্যে অন্যতম হলো বেনাপোল-পেট্রাপোল রুটে পার্শ্ব-দরজা বিশিষ্ট কন্টেইনার ট্রেন চালুর অনুমতি প্রদান। সুপারিশের আলোকে ৬টি শর্তসাপেক্ষে রেলকার্গোর অনুমতি প্রদান করা হলো। শর্তের মধ্যে বলা হয়, বেনাপোল কাস্টম হাউসকে রেলপথে আমদানি করা পণ্যের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্নের একটি আর্দশ পদ্ধতি প্রণয়নপূর্বক এনবিআরকে অবহিত করতে হবে। পণ্য আমদানির পূর্বে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে বন্দর অভ্যন্তরে পণ্যের অবতরণ, সংরক্ষণ ও কায়িক পরীক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় পূর্তকাজ সম্পন্ন করতে হবে। সকল পণ্য সহকারী কমিশনার বা উপ-কমিশনারের উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ঘোষণার যথার্থতা যাচাই ও যথাযথ শুল্ককর আদায় নিশ্চিতকল্পে আইনানুগ সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমদানি নীতি আদেশসহ সকল আইন ও বিধি-বিধান পরিপালন করতে হবে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সাইড ডোর কন্টেইনার ট্রেন চলাচলের বিষয়টি পুনঃপর্যালোচনা করতে হবে। এ লক্ষে রেলপথে আমদানি-রপ্তানির তথ্য নিয়মিতভাবে এনবিআরকে অবহিত করতে হবে। এদিকে রেলকার্গোতে পণ্য আমদানি প্রসঙ্গে বেনাপোল কাস্টম ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, বেনাপোল এশিয়ান হাইওয়ের ট্রানজিট করিডোরের প্রথম গেটওয়ে। ভারতের সাথে এই বন্দর দিয়ে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এখান থেকে সরকার প্রতি বছর সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে থাকে। শূন্যরেখা থেকে বেনাপোল রেল স্টেশন পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রেলপথ বেনাপোল বন্দরের মধ্য দিয়ে এসেছে। সেখানে সামান্য ভূমি উন্নয়ন করলে রেল কন্টেইনার হ্যান্ডলিং উপযোগী হবে। বেনাপোল বন্দরের প্রায় ১০০ একর জায়গার মধ্যে ২০ একর জায়গা আছে যা হেভি কম্পেকশনসহ ৪০ ফুট লোড কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করার উপযোগী। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী জানান, বেনাপোল-পেট্রাপোলের সকল অংশীজন এনবিআরের আদেশের আলোকে নিজ নিজ পণ্য বা কার্গো আমদানি করতে করতে পারবেন। পূর্বে কেবল বাল্ক কার্গো যেমন পাথর, পাথর চিপস্, ধান, চাল, গম রেলে আমদানি হতো। এখন থেকে সব রকমের পণ্য পণ্যবাহী ট্রেনে করে আনা যাবে।