নিজেস্ব প্রতিনিধি : সরকারি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে না আসায় ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেশি দাম বিদ্যুৎ কিনছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। ফলে সংস্থারি ঋণের বোঝা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিচালন ব্যয় মেটাতে সরকারের দ্বারস্থ সংস্থাটিকে হতে হচ্ছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছর সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর গত ৮ বছরে সরকারের কাছ থেকে নেয়া বিপিডিপির ঋণের পরিমাণ প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা। বিপিডিবির ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশ, যা সমতুল্য অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ। আন্তর্জাতিক রেটিং প্রতিষ্ঠান মুডিসের মতে, ভঙ্গুর আর্থিক অবস্থা ও সীমিত সক্ষমতার কারণে ভবিষ্যতে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। চাহিদা সেভাবে না বাড়লেও গত কয়েক বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ধরনের মোট ১৩৭টি জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও রয়েছে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল, আইপিপি ও স্মল ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (এসআইপিপি)। তবে গ্যাস সংকট, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ আরো বিভিন্ন কারণে ওসব কেন্দ্রের সবগুলো একসঙ্গে উৎপাদনে থাকে না। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদার ভিত্তিতে উৎপাদন হচ্ছে তার অর্ধেক। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কমেছে। চাহিদা না থাকায় কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলেও সর্বশেষ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা, যা বছর বছর বেড়েই চলেছে। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছর বিপিডিবিকে দেয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর বিপিডিবির ঋণ ছিল ৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর ২ হাজার ৭৯০ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৩ হাজার ৯৯০ কোটি আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে ঋণ নেয় বিপিডিবি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত হিসেবে তার পরিমাণ ছিল সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছর সরকারের কাছ থেকে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বিপিডিবি। ফলে গত ৮ বছরে সরকারের কাছ থেকে সংস্থাটির নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর এ অঙ্ক অর্ধ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে ১২ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৪৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন ও ২ হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাছাড়া ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন আছে। একই সাথে ১৯ হাজার ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। আগামী অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৪ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত হিসাবে বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।
এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ কয়লাভিত্তিক আরো বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাশিয়ান ফেডারেশনের আর্থিক সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ ১৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা)। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মোট নির্মাণ ব্যয়ের ৯০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া। তাছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও নেয়া হয়েছে বিপুল অংকের ঋণ। দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করছে সরকার, দেশের তফসিলি ব্যাংক, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী, এডিবিসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও এ খাতে বিনিয়োগের একটি অংশ এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। এডিবি বিনিয়োগ করেছে ২০৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ১২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে বিশ্বব্যাংক। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারতের এক্সিম ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে ১৬০ কোটি ডলার। একইভাবে চীনের এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। তাছাড়াও বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে সম্পন্ন, চলমান ও পরিকল্পনাধীন মিলিয়ে ৮০টির বেশি প্রকল্প রয়েছে। সম্পন্ন, চলমান ও পরিকল্পনাধীন মিলিয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজন মোট ১ হাজার ৪২৪ কোটি ডলার। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ক্ষেত্রেও প্রায় ৬০টির মতো প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান লাইনের সংস্কারের প্রয়োজনে ওসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে। চলমান ও পরিকল্পনাধীন মিলিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে ১ হাজার ৮০ কোটি ডলার।
অন্যদিকে দেশের বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬ অনুযায়ী, ২০২০ সালের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৯ মেগাওয়াট। তাছাড়া ২০২১ সালের জন্য ১৫ হাজার ৩৯৪, ২০২৫ সালের জন্য ২১ হাজার ৯০৩, ২০৩০ সালের জন্য ৩২ হাজার ১৯৮, ২০৩৫ সালের জন্য ৪৪ হাজার ৪৮৩ ও ২০৪১ সালের জন্য ৬১ হাজার ৬৮১ মেগাওয়াট। এর পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির পতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের জন্য ১৭ হাজার ১৫, ২০২১ সালের জন্য ১৯ হাজার ৩৪, ২০২৫ সালের জন্য ২৮ হাজার ২৩১, ২০৩০ সালের জন্য ৪১ হাজার ৮৯০, ২০৩৫ সালের জন্য ৫৯ হাজার ২৭৫ ও ২০৪১ সালের জন্য ৮২ হাজার ২৯২ মেগাওয়াট। নিজস্ব উৎপাদন ছাড়াও ২০৪১ সাল নাগাদ সরকারের নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বিদ্যুৎ খাতে সরকারি প্রকল্পগুলোর ঋণের বেশির ভাগই সহজ শর্তে নেয়া। সামগ্রিকভাবে দেখা হলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের প্রকল্পগুলো বহুগুণিতক প্রভাব রাখছে। ফলে ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলেও সেগুলো নানাভাবে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।