মীর আলাউদ্দিন : দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে। মজুদও রয়েছে যথেষ্ট। তারপরও গমের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে এক শ্রেণীর অতি মুনাফালোভী মজুদদার ও ব্যবসায়ী। বর্তমানে খাদ্য শিল্প ও রেস্তোরাঁগুলোতে গমের তেমন চাহিদা না থাকলেও প্রান্তি পর্যায়ে চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। আর এ সুযোগকেই কাজে লাগাতে চাচ্ছে ওই চক্র। দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজারে সপ্তাহখানেক ধরেই ডিও পদ্ধতিতে কেনাবেচা হওয়া গমের দাম বাড়তি দিকে। অথচ আমদানি বেশি হওয়ায় এ মুহূর্তে দেশে গমের কোনো সঙ্কট নেই। তারপরেও গমের দাম মণপ্রতি ৭০-৮০ টাকা করে বেড়েছে। ফলে ফ্লাওয়ার মিলগুলোও এখন আটা-ময়দার দাম বাড়িয়েছে। আর প্রান্তিক সাধারণ মানুষের মধ্যে আটার চাহিদা বাড়তির দিকে থাকায় দেশে গমের বাজার আরো অস্থির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গম ব্যবসা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশ্ববাজারে এখন গমের দাম নিম্নমুখী। কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কম থাকায় ব্যবসায়ীরা গত অর্থবছরের চেয়ে টনপ্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা কম দামে গম আমদানি করছে। ইনডেক্স মুন্ডির তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ্ববাজারে গমের টনপ্রতি দাম ছিল ১৯৯ ডলার ৫২ সেন্ট। তারপর নভেম্বরে কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ২০৩ ডলার ১৯ সেন্ট, ডিসেম্বরে ২১০ ডলার ৯১ সেন্ট। তারপর দাম আরো বেড়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পণ্যটি বিক্রি হয় টনপ্রতি ২২৪ ডলার ৫০ সেন্টে। ফেব্রুয়ারিতে গমের দাম কমে নেমে আসে ২১৫ ডলার ৩২ সেন্টে। বিশ্ববাজারে এক মাসের ব্যবধানে ৪ শতাংশের বেশি দাম কমলেও দেশের বাজারে আমদানিকারকরা শূন্য শুল্কের নিত্যপণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৫০ লাখ টন গম দেশে আমদানি হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহ ছাড়াও স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে গম আমদানি অব্যাহত ছিল। পাশাপাশি ছিল আগের মজুদও। এ সময় দেশে গম আমদানি বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। তারপরও সঙ্কটের অজুহাত তুলে বিগত কয়েকদিন ধরে নিয়মিতভাবেই পণ্যটির দাম বাড়িয়েছে আমদানিকারকরা। বাজারে বর্তমানে খুচরায় প্রতি কেজি প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ৩২-৩৫ টাকায়, প্যাকেট ময়দা কোম্পানিভেদে ৪২ থেকে ৪৮ টাকায়। তাছাড়া খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ২৬ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে এবং ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৮ টাকা দরে। মিলগুলো খোলা আটা-ময়দার দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে আমদানি প্রক্রিয়ায় থাকা প্রচুর গম। তাছাড়া বিভিন্ন গুদামেও পণ্যটির পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রতি মণ কানাডীয় গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকা দরে। দাছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানি করা গম মানভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯০০ টাকায়। উভয় দেশ থেকে আমদানি করা গমের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে মণে ৭০-৮০ টাকা। তাছাড়া চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫০ লাখ টন। এ গমের আমদানি মূল্য ১০ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন (১ হাজার কেজি) গম আমদানিতে ব্যবসায়ীদের ব্যয় করতে হয়েছে গড়ে ২০ হাজার ৩১৪ টাকা। অথচ গত অর্থবছরের (২০১৮-১৯) একই সময়ে দেশে গম আমদানি হয়েছিল ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যার আমদানি মূল্য ছিল ৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা এবং টনপ্রতি আমদানি মূল্য ছিল গড়ে ২২ হাজার ৭৫ টাকা করে। অর্থাৎ আমদানি বাড়ার পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের পণ্যটির টনপ্রতি মূল্য কম পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ২ হাজার টাকা। তারপরেও শূন্য শুল্কের পণ্যটির দাম হঠাৎ বাড়িয়ে বাজার থেকে বাড়তি মুনাফা তুলে নিচ্ছে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। সূত্র আরো জানায়, আটার ওপর নির্ভরশীল থাকে দেশের সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ। দেশে শতাধিক ব্র্যান্ডের প্যাকেটেড আটা-ময়দা বিক্রি হলেও গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের ভরসা খোলা আটা-ময়দা। বিদ্যমান সঙ্কটকালে আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপদে রয়েছে নিম্নবিত্তের মানুষ। পাইকারি বাজারে আটা-ময়দার বিক্রি এখন বেশি। প্যাকেটজাত পণ্যের পাশাপাশি খোলা আটারও চাহিদা বেশি। হঠাৎ করেই অতিরিক্ত চাহিদার সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকরাও গমের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরবরাহ সঙ্কটের কথাই বলছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন ফ্লাওয়ার মিলে ডিও পদ্ধতিতে গম সরবরাহ করছে। ফ্লাওয়ার মিলগুলো থেকেই গমের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। আর ক্রেতারা বাড়তি দামে কিনতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বর্ধিত দামই স্থিতিশীল হয়ে যায়। এ বিষয়ে সেনা কল্যাণ সংস্থার ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের ফ্লাওয়ার ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন জানান, দেশে গমের আমদানি পর্যাপ্ত। কয়েক মাস ধরেই গমের দাম ও সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে বিচ্ছিন্নতার নীতি কার্যকরের পর পরই গমের দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য উৎপাদিত গম, বিশেষত রাশিয়া থেকে আমদানি করা গমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এতে চাহিদা তুলনামূলক কম হলেও পণ্যের (আটা-ময়দার) দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।