শেষ থেকেই শুরু:
২৯ মে রাত ১১ টা ২৯ মিনিট। শুয়ে পড়েছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। হঠাৎ মোবাইলের মেসেজ টোন বাজল। আগ্রহ ভরে হাতে নিয়ে চেক করলাম। দেখি সেন্ডার ব্র্যাক। মেসেজ খুলে দেখি করোনা টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ। সত্যিই তখন যা মনে হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। মনে মনে খালি বললাম আল্লাহ তুমি সত্যিই মহান। এই যাত্রায় প্রাণটা ফিরিয়ে দিয়েছ। শুকরিয়া। কোভিড-১৯ এর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে টানা ১৯ দিনের যে ধকলটা গেছে সেটা মুহুর্তেই ভুলে গেলাম সেদিন।
তার আগে গত ১৭ মে দুপুর সাড়ে ১২ টায় হঠাৎ মোবাইলে একটা মেসেজ আসল। খুলে দেখলাম সেটাই সেই অকাঙ্খিত মেসেজ। যেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুুত ছিলান না। মেসেজ খুলে দেখলাম সেখানে লেখা আপনি কোভিড-১৯ পজিটিভ। ফার্দার কোন প্রয়োজন হলে ফোন করুন ৩৩৩ তে। অবশ্য এই মেসেজ পাওয়ার আগে ১৩ মে আমি ফোন করেছিলাম ৩৩৩ তে। সব শুনে আমাকে আইসোলেনশে থাকার পরামর্শ দিল ডাক্তারবাবু। কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করলাম টেস্ট করাবো কিনা। টেস্টের ব্যাপারে শতভাগ নিরুৎসাহিত করা হলো। আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম টেস্টে না করালে আইসোলেশন কেন? ওপাশ থেকে বলল আপনি সন্দেভাজন। আমি বললাম, আমি সন্দেহভাজন বলেই তো টেস্ট করানো দরকার। নিশ্চিত হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার কথা তিনি ভালভাবে নিলেন না। যাই হোক আমি ফোন রেখে দিলাম। পরদিন ১৪ মে ডিআরইউতে নমুনা দেওয়ার পর বাসায় ফিরে পৃথক একটা রুমে ঢুকে গেলাম। সেই সাথে পুরো পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। এবং এই একাকাীত্বের যুদ্ধ্টা চলল ২৯ মে রাত দুপুর পর্যন্ত। মাঝে একটা ঈদ গেছে। আমাদের কারো ঈদ ছিল না। এটা অবশ্য পুরো বিশে^রই পরিস্থিতি। ৩০ মে দুপুরে আমার বড় ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করল বাবা ঈদ কি আসবে না। আমি তার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে বললাম বাবা আজকেই তো আমাদের ঈদ। চল আজ আমরা ছাদে যাবো। অনেকক্ষন থাকবো। ১৪ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অবিরতভাবে গরম পানির জলীয় বাস্প নেওয়া, রং চা, মাল্টা, লেবু, আনারস, তরমুজ, বাংগী খেয়েছি প্রচুর পরিমাণে। ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১ মে পাচদিনে আমরা পরিবারের সবাই (৪ জন) অন্তত ২০০ পিছ নানাভাবে লেবু খেয়েছি। আর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীা, নাপা ্এক্সটেন্ড, এজিথ্রোমাইসিন, জিংকসহ কয়েকটি ওষুধের একটা কোর্স পূর্ণ করেছি। ১৭ মে থেকে ২৯ মে পুরো সময়টা প্রতিদিন ঘন্টায় ঘন্টায় আমার আপডেট নিয়েছে আমার কাজিন ডাক্তার আহমেদ মাহী বুলবুল। তিনিই মূলত আমাকে সবচেয়ে বেশি শক্তি আর সাহস যুগিয়েছেন।
আমার অভিজ্ঞতা:
আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার পর থেকে নেগেটিভ হওয়া পর্যন্ত ১৯ দিনের সময়টা বোধ হয় সারাজীবনই মনে থাকবে। সেটা ছিল সত্যিকার অর্থে একটা মারাত্বক ম্যানটাল ট্রমা। এই ট্রমার চাপটা যদি আপনি নিতে পারেন তবেই আপনি জয়ী হবেন করোনা যুদ্ধে। এছাড়া একই সাথে এই পচে যাওয়া নষ্ট সমাজটার সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়াটা বেশ কঠিন বৈকি। যেখানে আপনি কোরোনায় আক্রান্ত হলে সমাজ, পরিবার-পরিজন সবাই পর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের যে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের গল্পগুলো ছিল শত বছরের, সেগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখানে বাবা, মা, ভাই বোন কেউই কারো জন্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা এই রাষ্ট্রের কাছ থেকে আপনি কিছুই আশা করতে পারবেন না। শুধু প্র্রতি বছর ট্যাক্স দিয়ে যাবেন। আর ঐ ট্যাক্সের টাকায় হাসপাতাল, ভবন, ব্রিজ বানানোর নাম করে চুরি করবে একটি গোষ্ঠী। আবার আপনি তাদেরকে চোরও বলতে পারবেন না। এখানে যারা মানসিকভাবে হেরে যায়। তারাই করোনা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন বলে আমার মনে হয়। তবে যারা আগেই থেকেই নানা রোগে জর্জরিত। বয়স বয়স্ক। তাদের হিসাবটা ভিন্ন। যদিও আমি নিজেও একজন অ্যাজমা রোগী। আর যারা কম বয়সী হওয়া সত্বেও হেরে যাচ্ছেন তারা আসলে কারো কারো নিষ্ঠুরতা, চিকিৎসার অপ্রতুলতা আর পচে যাওয়া সমাজটার কাছে হেরে যাচেছন। আমি আক্রান্ত হওয়ার পর। আমার পাশের ফ্লাটের বাসিন্দাদের পর্যন্ত টের পেতে দিই নি। ২৯ মে নেগেটিভ হওয়ার পর যখন নিচে নেমেছি। তখন বাড়ির দাড়োয়ান, কেয়ারটেকার এমনকি নিচ তলায় থাকেন এক ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আমি নিজে থেকে শেয়ার করেছি। তারা এক প্রকার অবাকই হয়েছেন।
লড়াইটা ছিল বাঁচার জন্য :
সবচেয়ে ভয়ংকর সময় কেটেছে পাঁচদিন। এই কয়েকদিন আমার পাতলা পায়খানা, শরীর দুর্বল, খাবারের গন্ধহীনতা, নিদ্রাহীনতা, কিছুটা দুশ্চিন্তা চরমভাবে ভুগিয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি শ^াস:প্রশাসে। মাঝে মাঝে মাথা ওপরের দিকে করে শুধুই আল্লাহকে ডেকেছি। পৃথিবীতে শ^াসকষ্টের চেয়ে বড় কোন কষ্ট আছে বলে আমার মনে হয় না। এজন্য প্রতিদিন নেবুলাইজ করেছি। ইনহেলার নিয়েছি। ব্যায়ম করেছি। কুসুম গরম পানিতে নিয়মিত গোসল করেছি। আর এই কদিন নিয়মিত খাবারগুলো অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হারে খেয়েছি। সাথে প্রতিদিন দুটি করে ডিম, দুধ, ফলফলাদি খেয়েছি প্রচুর। তবে আমি আমার একাকিত্বের সময়টাকে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। এ সময় অনেক পুরনো দিনের সিনেমা, নাটক দেখেছি। কিছু লেখালেখির কাজ করেছি। আমহদ ছফা আর সৈয়দ মুজতবা আলী বই পড়েছি। কোরআনের বাংলা অনুবাদ পড়েছি। ফাকে ফাকে অফিসের জন্য রিপোর্ট তৈরি করেছি। সোর্সদের সাথে কথা বলার সময় কাউকেই বলিনি যে আমি কোরোনা পজিটিভ। অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। কিন্তু একজন চিকিৎসক বন্ধুকে ছাড়া আর কাউকেই বলিনি আমি করোনায় আক্রান্ত। তবে শ্রদ্ধাভাজন ড. হোসেন জিল্লুর রহমানকে রিপোর্টের কাজে ফোন করলে তিনি কিভাবে যেন জানতে পেরেছিলেন। তিনি আমায় বেশ সাহস দিলেন। এবং পরে অনেক বার খবরও নিয়েছেন। ্্এইদিনগুলোতে যেমন নাটক সিমেনা দেখেছি। তেমন আল্লহর কাছে কেঁদেছি প্রতিদিনই। রোজা রাখতে না পারায় বেশ কষ্টও পেয়েছি মানসিকভাবে। কয়েকজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়ও কেঁদেছি হুহু করে। তবে মনোবল হারাইনি এক মুহুর্তের জন্যও। বার বার মনে হয়েছে আমাকে য়ুদ্ধ করে বাঁচতে হবে। এ ভাইরাসকে পরাজিত করতেই হবে। তবে বার বার মন খারাপ হয়েছে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য। বিশেষ করে আমার ১১ মাস বয়সী ও সাত বছর বয়সী ছেলে দুটোর জন্য। ভয় হতো যদি আমার কাছ থেকে তারা সংক্রমিত হয়। তাহলে কি করবো। কোথায় যাবো। ইত্যাদি, ইত্যাদি। ১৭ মে থেকে অবশ্য আমার স্ত্রী, ছোট ভাই ওদের দুজনের প্রায় সব ধরনের উপসর্গ ছিল। কিন্তু সেগুলো সহনীয়। এজন্য আমরা সবাই একই রকম খাবার খেয়েছি। একই নিয়মে চলেছি। একই চিকিৎসা নিয়েছি। প্রত্যেকেই মাস্ক ব্যবহার করেছি। পরবর্তীতে আমার ছোট ভাইয়ের অবশ্য নেগেটিভ এসেছে। সেটা ৪ জুনে।
শুরুর গল্প :
শুরুর গল্পটা এমন, গত ১০ মে। অফিসে কাজ করছি। আসরের নামাজের জন্য চেয়ার থেকে উঠলাম। মাথা চক্কর দিল। যা এর আগে কখনো হয়নি। ভাবলাম রোজার কারণে হতে পারে। কিছু সময় বসলাম আবার চেয়ারে। মিনিট পাঁচেক পরে আবার উঠলাম। এবার ওযু করে নামাজ শেষে আবার কাজে বসলাম। এইরমেধ্যে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি বাসা থেকে কিছু ইফতারি আইটেম নিয়ে যেতাম রেগুলাার। অফিস থেকে যেটা সরবরাহ করা হতো সেখান থেকে দু,একটা খেতাম। সেদিন শুধু খেজুর, সরবত, আর কলা খেলাম। অনেকটা জোর করেই। ভাবলাম রোজার ক্লান্তি। বেশি করে গরম পানি খেলাম। আমি এমনিতেই প্রায় সারাবছর কুসুম গরম পানি খাই। গরম পানিতে গোসলও করি । সেদিন বাসা থেকে নেয়া সবজি খিচুুড়িটাও খেলাম জোর করে। খেতে গেলেই বমি চলে আসতো। রাতে বাসায় ফিরলাম। আর কোন সমস্যা বোধ করলাম না। কিন্তু রাতে ঘুম হল না। শরীরে প্রচন্ড ব্যথ্যা। বিশেষত পিঠে। আমি ভাবলাম বোধ হয় ব্যাক পেইন। পেইন কিলারও খেলাম সেহারীতে। পরদিন অফিসে গেলাম যথারীতি। সেদিন আর কোন সমস্যা নাই। কিন্তু ১১ মে রাতেও ঘুম হল না। শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। জ্বর জ্বর ভাব। কিন্তু জ্বর নেই। দিন টা কেটে গেল। পরদিন ১২ মে। বিকাল বেলা শরীরে কোন বল পাচ্ছি না। কোন রকমে আসরের নামাজ পড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে সময় গুনছি। কখন ইফতার হবে । প্রচন্ড পানির পিপাসা । গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট করে সময় টা পার করলাম। কিন্তু ইফতারিতে কিছু খেতে পারলামা না। বাসায় ফিরলাম। সেহরী খেলাম ঠিকমত। পরদিন ১৩ মে বাসা থেকে অফিস করছি। দুপুরের পর হঠাৎ গায়ে জ্বর। এরইমধ্যে শরীরর ব্যথাটা বেড়েছে। সামান্য গলা ব্যথা মনে হলো। তবে কাশি ছিল না। আমার স্ত্রীর সাথে শেয়ার করলাম। বললাম আমার শরীরটা খুব দুর্বল। হাত পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। তার পরামর্শে জোহরের নামাজের পর রোজাটা ভেঙ্গে ফেললাম। জ্বরের জন্য প্লেন নাপা খেলাম। ঘন্টাখানেক পর জ্বর চলে গেছে। কিন্তু শরীর দুর্বল। ইতফারের সময় কিছু মুখোরোচক খাবার খেলাম। প্রচুর পানি খেলাম। কিন্তু পিপাসা যাচ্ছে না। আবার জ্বর জ্বর লাগছে। কিন্তু থার্মোমিটারে দেখি কোন জ্বর নাই। তাপমাত্রা ৯৭.৫ ডিগ্রী।
এবার ডিআরইউ সেক্রেটারিকে রিয়াজ চৌধুুরীকে ফোন করে বললাম আমার শরীরটা কেমন জানি করছে। কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে চাই। তিনি বললেন আরে না আপনার তেমন কিছূ হয়িন। ভয় পাইয়েন না। তবে টেস্ট করান। রাতে খালিদ সাইফুল্লাহ ফোন করে বললেন ভাই কাল সকালে চলে আসেন। টেস্ট করাতে । সেদিন সেহরীর সময় আবারো জ্বর আসল। নাপা খেলাম সেহরী খেয়ে। ১৪ মে সকালে ডিআরইউ গেলাম। রিক্সাযোগে সেম্পল দিয়ে ইচ্ছে করেই হাঁটলাম কাকরাইল পর্যন্ত। ভাবলাম দেখি কোন ক্লান্তি আসে কিনা। না মনে হল সব ঠিকঠাক। বাসায় ফিরে গোসল করে রোজা ভেঙ্গে ফেললাম। আমার ছেলে কল্প আর স্ত্রীকে বললাম আমার সাথে আপাতত তোমাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ থাকবে। রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত আলাদা থাকি। একা এক ঘরে দরজা লাগিয়ে থাকতে প্রথমে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। এখানে বলে রাখা ভাল আমি অফিস কামাই করিনি। প্রতিদিনই নিউজ দিচ্ছি বাসায় বসে বসে । মোবাইল ফোন, মেইল, ফেসবুকের মাধ্যমে সোর্সদের সাথেও যোগাযোগ রাখছি। এরইমধ্যে অফিসকে জানিয়েছি আসার সার্বিক অবস্থা। চিফ রিপোর্টার বললেন তুমি বাসায় থেকে কাজ কর। যাই হোক ১৪ মে থেকে ১৬ মে কেটে গেল একা ঘরে। নিজের খাবার প্লেট, বাটি, মগ, চামচ সব আলাদা করে ফেলেছি এরইমধ্যে। আমার ছেলেরা কাছে আসার জন্য অনেক কান্নাকাটি করতো। কিন্তু নিতাম না। দরজার ওপার থেকেই বলতাম বাবা অসুস্থ। কদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ কদিন আমার কোন উপসর্গই ছিল না। আমি সম্পূর্ন সুস্থ বোধ করেছি। এ সময় আমার অফিস কলিগরা অনেকেই ফোন করে জানতে চেয়েছেন আমার অবস্থা। আমি বলেছি। রিপোর্ট আসেনি এখনো। তবে আমি সূস্থ আছি। ১৭ মে দুপুরে যখন রেজাল্ট পেলাম। তখন মাঝায় যেন বাজ পড়ল। কাকে জানাবো কি করব। এরজন্য অন্তত আধা ঘন্ট সয়ম চুপচাপ খালি ভেবেছি। অবশেষে স্ত্রীর সাথে শেয়ার করেছি। আর বলেছি। ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করতে হবে। চিন্তা করো না । আমি সুস্থ বোধ করছি। সেদিই বিকাল থেকেই মূলত আমি শ^াসকষ্ট অনুভব করতে থাকি। যা ২৫ মে পর্যন্ত ছিল।