নিজেস্ব প্রতিনিধি : বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো (এনজিও) দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের অবদান রেখেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সঙ্কটেও ওসব সংস্থা সময়োপযোগী সাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের খাদ্য, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে এনজিওগুলো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে ওসব প্রতিষ্ঠানের আশানুরূপ সাড়া নেই। তবে দু’একটি বড় এনজিও স্বল্প পরিসরে কিছু উদ্যোগ নিলেও সার্বিকভাবে করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় এনজিওগুলোর অবদান তেমন একটা দৃশ্যমান নেই। সমাজকর্মী এবং এনজিও খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯ ইতিমধ্যে দেশে বড় ধরনের কিছু সঙ্কট তৈরি করেছে। তা মোকাবেলায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কার্যকর ও শক্তিশালী করে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন ধরনের কাজগুলোয় এনজিওগুলো বরাবরই এগিয়ে এলেও করোনাজনিত সঙ্কটে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা একেবারেই যৎসামান্য। অথচ দারিদ্র্য ও সচেতনতাহীনতার কারণে দেশের বস্তি এলাকার ভাসমান মানুষও এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ সুরক্ষা উপকরণ পৌঁছাচ্ছে না। অথচ সারাদেশের এনজিওগুলোর ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে প্রায় ৪২ লাখ যুক্ত গ্রাহক রয়েছে। তার মধ্যে সরাসরি ঋণ নিয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। তাদের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। কিন্তুচলমান করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বহুমুখী অভিঘাতে ওসব মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্নপ্রায়। ওসব ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর ব্যাপক কাজ করার সুযোগ থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই নিশ্চুপ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কয়েক দশকে বেশকিছু দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ওসব দুর্যোগ মোকাবেলায় এনজিওগুলো সরকারের পাশাপাশি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। সচেতনতা তৈরি থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক ও নানা ধরনের সহায়তা নিয়ে এনজিওগুলো এগিয়ে এসেছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা সঙ্কটেও দেশী-বিদেশী এনজিওগুলো প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এনজিওগুলোর উপস্থিতি সেভাবে চোখে পড়ছে না।
এদিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) করোনা মোকাবেলায় সচেতন জীবনযাপনের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণের কাছে এ সচেতন জীবনযাপনের গুরুত্ব সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না। তাছাড়া কভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সহায়তা পৌঁছানোও জরুরি। সামনের দিনগুলোয় সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়লে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি জরুরি সচেতনতা ও সহায়তা কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে নিতেক এনজিওগুলোকেও আসতে হবে।
অন্যদিকে এনজিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণেই কভিড-১৯ ইস্যুতে স্থানীয় পর্যায়ে এনজিওগুলোর কার্যক্রম তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে অনেক সংস্থাই নিজের সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ দিতে প্রস্তুত রয়েছে। ইতিমধ্যে এনজিওগুলো সরকার ঘোষিত ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রেখেছে। প্রশাসনে যতটুকু সম্ভব আর্থিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু জনগণের সচেতনতা বাড়াতে কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন তা করা সম্ভব হচ্ছে না মূলত নিজের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি বিবেচনায়। কারণ মাঠের অনেক কর্মী ছুটিতে থাকতে চাইছেন। তবে পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ পেলে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের আরো কাজে লাগানো সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এনজিওগুলোর কার্যক্রম যে একেবারেই নেই, তা নয়। কভিড-১৯-এর ঝুঁকি মোকাবেলায় ব্র্যাক তার সামর্থ্যরে সবটুকু সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য দুই লাখ মাস্ক তৈরি করছে। দেশেই পিপিই বা সুরক্ষা পোশাক তৈরির বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ব্র্যাকের ৫০ হাজারেরও বেশি মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী দেশের ৬১ জেলার তৃণমূল মানুষের কাছে কভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবেলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবার্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ পৌঁছে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছে। ব্র্যাক তার ঋণ কর্মসূচির কিস্তি জমাদান ২৪ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে। ডিজিটাল মাধ্যমেও ব্র্যাক তথ্যসেবা দিচ্ছে। একই বিষয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এনজিও আশার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল জানান, করোনা পরিস্থিতি সামষ্টিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে কর্মীদের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। প্রয়োজন হলে বিশেষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এনজিওগুলো সরকার ঘোষিত ঋণের কিস্তি মওকুফের সময় আরো বাড়িয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে পারে। পাশাপাশি এনজিওগুলোর সিএসআর ফান্ড রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সীমিত আয়ের কিংবা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হবে। এনজিওগুলো সিএসআর ফান্ডের মাধ্যমে সীমিত আয়ের কিংবা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিকল্প কর্মসূচি চালু করতে পারে। করোনা-পরবর্তী সময়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানসম্পন্ন জীবিকা নির্বাহে এনজিওগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন।