নিজেস্ব প্রতিনিধি : দক্ষ জনবলের অভাবে করোনা পরীক্ষা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অনেক ক্ষেত্রেই নমুনা পরীক্ষার ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি রিপোর্ট দিতেও অনেক সময় লাগছে। তাছাড়া ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়লেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতাশিত দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ১০ হাজার হচ্ছে না। বরং ওই সংখ্যা ৫ থেকে ৭ হাজারের মধ্যেই থাকছে। আর ল্যাবরেটরিতে সংগ্রহ করা নমুনার স্তূপ বাড়তে থাকলেও পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে করোনার নমুনা পরীক্ষার জটিলতা কাটছেই না। তবে সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, সঠিক পরিকল্পনা না থাকা কারণেই করোনার পরীক্ষা নিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনার নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি এবং নমুনার মানের ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণার আগে থেকেই রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটির মতে, চিকিৎসা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে রোগ শনাক্ত হওয়া দরকার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এতোদিন করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধান করছিল। গত দেড় সপ্তাহ ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতর ওই দায়িত্ব পালন করছে। আইইডিসিআর ঢাকার বাইরে থেকে নমুনা সংগ্রহ করতো না। ফলে দেশব্যাপী নমুনা সংগ্রহের প্রস্তুতি গড়ে ওঠেনি। আর স্বাস্থ্য অধিদফতর হঠাৎ এ দায়িত্ব পেয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরে করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সেজন্য নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পাত্রজাত করা এবং নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকছে। ফলে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে বেশি সময় নেয়া হচ্ছে। দিনে প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে সংগৃহীত নমুনার সংখ্যা কম থাকার পরও অনেকেই দিনের পর দিন ঘুরে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছে না। অথচ দেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে ব্যাপক নমুনা পরীক্ষা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে দৈনিক প্রায় ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর সারাদেশ থেকে করোনা নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু সারাদেশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে দক্ষ জনবল সঙ্কটে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সীমিত সংখ্যক সরকারি মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট দিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর পরিস্থিতি সামাল দিতে তাড়াহুড়া করে নমুনা সংগ্রহে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের হেলথ প্রোভাইডারদের সম্পৃক্ত করার ঘোষণা দিয়েও স্বাস্থ্য অধিদফতর সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ নমুনা সংগ্রহের কাজটি মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের পক্ষেই দক্ষতার সঙ্গে নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। আর নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা পরিচালনা, ফল জানানো এবং শনাক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়গুলো খুবই জরুরি।
সূত্র আরো জানায়, ল্যাবরেটরিগুলোতে সঠিক সময়ে নমুনা সংগ্রহে জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন ল্যাবটেরিতে জমা হচ্ছে সংগৃহীত নমুনা। আর জমে থাকা নমুনা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো থেকে সংগৃহীত নমুনাসমূহ নির্বাচিত ল্যাবগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সংগৃহীত নমুনাসমূহ অনেক সময়ই সঠিক সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠছে না। যদিও অধিদফতর সংশ্লিষ্টদের দাবি- তাতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ সংগৃহীত নমুনাগুলো বিশেষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যারা আগে নমুনা দিচ্ছে, তাদের পরীক্ষা আগে হচ্ছে। কিন্তু অনেকে যোগাযোগ করে দিনে দিনেই পরীক্ষা করাতে পারছে। অল্প সময়ে পরীক্ষার ফলও জানতে পারছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালীদের অনুরোধ রাখতে গিয়েই নমুনা সংগ্রহ ও ফল জানাতে জটিলতা হচ্ছে। তাছাড়া অনেক জায়গায় নমুনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক সময় মানসম্পন্ন নমুনা আসছে না। অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পাত্রজাত করা এবং নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকছে। এদিকে মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যাক টেকনোলজিস্ট নেই। বিগত এক দশক ধরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর। ফলে করোনা শনাক্তে ল্যাবের সংখ্যা বাড়ালেও প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অভাবে ঠিকভাবে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। ফলে সারাদেশ থেকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের নমুনা সংগ্রহ করে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি জানার সুযোগ স্বাস্থ্য বিভাগের মিলছে না। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদেরকে দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে করোনা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হলেও বর্তমানে সীমিত সংখ্যক মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ওই কাজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় নিয়োজিত ৩৫ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে এবং অনেকে কোয়ারেন্টাইনে আছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সেজন্য নমুনা পরীক্ষার জন্য একের পর এক নতুন ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে সরকার। কিন্তু করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষার হার প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছতে পারছে না। তবে দৈনিক ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যদিও বিদ্যমান ল্যাবগুলো দিয়ে দৈনিক প্রায় ১৬ হাজার নমুনা পরীক্ষা করানো সম্ভব। কারণ প্রতিটি করোনা নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রতিটি পলিমার চেইন রিএ্যাকশন (পিসিআর) মেশিনে প্রতি শিফটে গড়ে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে পরীক্ষা করানো সম্ভব। অর্থাৎ সব কিছু ঠিক থাকলে ২৪ ঘণ্টায় একটি পিসিআর মেশিনে মোট ২৭০টি নমুনা পরীক্ষা করানো যায়। আইইডিসিআর’র ল্যাবে ৭টি, আইসিডিডিআর’বি ল্যাবে ৮টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ল্যাবে দুটিসহ চলমান ৪১টি ল্যাবে প্রায় ৬০টি পিসিআর মেশিন চালু রয়েছে। পাশাপাশি করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সারাদেশে প্রায় ৬০০ বুথ করা হচ্ছে। তবে বুথ স্থাপনে প্রথমে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর দিকে নজর দেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছেন, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। ল্যাবটেরির সংখ্যা ইতিমধ্যে ৪১টিতে উন্নীত করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের গতিও আরো বাড়াতে প্রায় ১২ হাজার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।