নিজেস্ব প্রতিনিধি : ধানের দাম না থাকায় গত মৌসুমে কৃষকদের অনেক লোকসান গুনতে হয়েছে। ওই ক্ষতি অনেকেই এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি। ইতিমধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার ধান চাষে সেচ খরচ আরো বেড়েছে। ফলে এবারও ধানের মূল্য নিয়ে কৃষকরা শঙ্কিত। যদিও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে খাদ্য অধিদপ্তর চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৪০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল থেকে ধান কেনার কথা থাকলেও হাওড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে তা এখনো শুরু হয়নি। ফলে অর্থের প্রয়োজনে সরকার ঘোষিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। আর সরকারের ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে এমন গড়িমসির সুযোগ নিচ্ছে ফড়িয়ারা। তাছাড়া সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও অধিকাংশ বর্গাচাষিই শর্তের বেড়াজালে আটকা পড়ছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা যেন সকল স্তরের কৃষকদের কাছে পৌঁছায় তারা তেমন পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে। কৃষক এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে কৃষকরা ধানের উৎপাদন ধরে রাখতে সব চেষ্টা চালাচ্ছে। অবশেষে তারা বোরো ধান ঘরে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাওরাঞ্চলে ৭৫ ভাগের বেশি ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান লাগানো হয়। এ বছর ফলনও ভালো হয়েছে। ফলে এবার দেশে ২ কোটি ৪ লাখ টনেরও বেশি ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ ভাগের যোগান দেয় হাওরাঞ্চলের বোরো ধান। এবার হাওরের ৭ জেলায় (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়) বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে এবং শুধু হাওরে ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। হাওরাঞ্চলে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার টন। সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে সারা দেশ থেকে ২ কোটি মণ বা ৮ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। প্রতি মণ ধানের দাম প্রায় ১ হাজার ৪০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই হিসাবে সারা দেশের কৃষক চলতি বোরো মৌসুমে সরকারের কাছে প্রায় ২ হাজার ৮০ কোটি টাকার ধান বিক্রি করবে। সরকারের ধান কেনা কার্যক্রম ২৬ এপ্রিল রোববার থেকে শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। তবে জেলা পর্যায়ে জটিলতার কারণে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। গত বোরো মৌসুমে ধানের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকের ঘরে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। ধান বেঁচে উৎপাদন খরচ তুলতে না পারায় কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের ঋণের জালে আটকে যায়। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে এবারো ধানের বাজার ঠিক রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। এবার কৃষক ধানের দাম ঠিকমতো না পেলে গ্রামের পরিস্থিতি গতবারের চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার এ মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান, ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনার ঘোষনা দিয়েছে। তবে সরাসরি ধান কিনলেই কৃষকরা স্বস্তি পাবে। সূত্র আরো জানায়, করোনা পরিস্থিতিতে বহু প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কৃষকের ঘরে ধান তোলা হচ্ছে। এখন কাঁচা ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। আর ধান শুকানোর পরে তা বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা মণ দরে। অথচ অঞ্চলভেদে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে ৭০০-৮৫০ টাকা খরচ হয়েছে। ফলে অনেক স্থানেই কৃষক ধান বিক্রিতে উৎপাদন খরচ পাচ্ছে না। লাভ তো দূরের কথা। তাছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় শ্রমিকও সঙ্কটও ছিল তীব্র। ফলে কৃষককে উচ্চমূল্য দিয়ে শ্রমিক নিতে হচ্ছে। কৃষকরা জানান, সরকারের ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের বিলম্বের কারণেই কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। লটারি কিংবা আনুষ্ঠানিকতা মেটাতে গিয়ে জেলা ধান ক্রয় কমিটি এখনো ধান ক্রয় শুরু করতে পারছে না। আর এই সুযোগে ফড়িয়ারা কম দামে ধান কিনছে। আর কর্তন খরচ মেটানো ও ঋণ পরিশোধের প্রয়োজনে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। এদিকে সরকারি ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হলেও কৃষকরা সরাসরি ক্রয়কেন্দ্রে ধান দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা। কারণ ইতিমধ্যে হাওড় অঞ্চলের প্রভাবশালী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি কার্ড নিয়ে নিচ্ছে। তারা বেশি দামে ধান কিনে নেবে এমন প্রলোভনও দেখানো হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রের অসৎ কর্মকর্তারা। তাদের কারণে সরকারের কাছে ধান দেয়া নিয়ে কৃষকদের মধ্যে আস্থাহীনতাও তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাওরাঞ্চলের অনেক স্থানে ধান ক্রয় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি এবং ফড়িয়া-মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট ও মিল মালিকদের কম দামে ধান কেনার সুযোগ করে দিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তালিকা করতে বিলম্ব কার অভিযোগ উঠেছে। কারণ সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান ক্রয় বিলম্বিত হলে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হবে।
অন্যদিকে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষি খাতের উৎপাদন ধরে রাখতে কৃষি খাতের কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রণোদনা প্রদান সংক্রান্ত সার্কুলারে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাতে দেশের ভূমিহীন কৃষক তথা বর্গাচাষিরা বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে এ সংক্রান্ত কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিগত ১৩ এপ্রিল জারিকৃত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বিক্রি করে থাকে, তারা এই ঋণ প্যাকেজের আওতায় আসবে। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা ঋণ পাবে। আবার সরকারের বিদ্যমান কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সেজন্য তাদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাদের জমি নেই তারাও এ ঋণ পাবেন, তবে সেক্ষেত্রে কৃষক যার জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন, সেই ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকরা চুক্তি করে জমি লিজ নিতে পারেন না। মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দেন না। কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে জমির মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ফি সরকারকে দিতে হয়। সেটি দিতে চান না বলে বেশির ভাগ জমির মালিক চুক্তিতে জমি বর্গা দেন না। যেহেতু চুক্তিপত্র নেই, সেহেতু প্রণোদনা প্যাকেজের কোনো সুবিধা ওসব কৃষক পাবেন না। ফলে শর্তের বেড়াজালে প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষিদের ঋণ ও প্রণোদনা পাওয়া নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্গা ও ভূমিহীন চাষিরা আগেই সুবিধাবঞ্চিত। অথচ তারাই দেশের কৃষি খাতকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সেক্ষেত্রে প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষিদের ‘লিখিত চুক্তিপত্র’-এর বদলে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ও সক্ষমতার ভিত্তিতে ঋুসহায়তা দেয়া হলে প্রকৃত কৃষকরা উপকৃত হবে। পাশাপাশি প্রণোদনায় শস্য ও ফসল আবাদের সবধরনের কৃষকদের প্রণোদনা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ কৃষক ক্ষতির মুখে পড়লে, পুরো দেশ আর দেশের মানুষকে তা ভোগাবে। এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, ধান কেনা কার্যক্রমে কৃষক নন এমন ব্যক্তি কিংবা বোরো আবাদ করেননি এমন কেউ যাতে কোনোভাবেই আসতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ধান কেনার লটারিতে কোনোভাবেই যেন মধ্যস্বত্বভোগীরা আসতে না পারেন, তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত আমন মৌসুমের মতো এবারো কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হবে। দ্রুত সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
একই প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক জানান, প্রতিকূল পরিবেশে হাওরের কৃষক যাতে সহজে যন্ত্রপাতি কিনতে পারে সেজন্য যন্ত্রের দামের ৩০% দেয় কৃষক এবং ৭০% দেয় সরকার। একই সাথে, দেশের অন্য এলাকা থেকে হাওরের আগাম বোরো ধান কাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার নিয়ে আসা হয়েছে। আগামী মাস থেকে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করবে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূূল্য বঞ্চিত না হয় সেজন্য প্রয়োজনে ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হবে।
Leave a Reply