নিজেস্ব প্রতিনিধি : বিশ্ব জুড়ে বহমান করোনা মহামারীতে বিভিন্ন দেশ খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘ থেকেও ওই আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। সেজন্য ইতিমধ্যে চাল ও গম উৎপাদনকারী অনেক দেশ পণ্য দুটির রফতানি বন্ধ কিংবা সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ শক্তিশালী করতে আউশের উৎপাদন বাড়াতেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেজন্য প্রথমবারের মতো আউশে দ্বিতীয় ধাপে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। যাতে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬ লাখ টন বাড়তি চাল উৎপাদন করা সম্ভব হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বোরো আবাদে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। পাশাপাশি বোরো চাষে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ওই বিবেচনায় গত কয়েক বছরের মতো চলতি আউশ মৌসুমেও কৃষককে প্রথম ধাপে বীজ, সার, সেচ সুবিধাসহ নগদ অর্থ দেয়া হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশের প্রায় ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৪৩৪ জন কৃষককে ৪১ লাখ ৮৬০ কেজি বীজ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) দেশে ১১ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ২৯ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের আউশ মৌসুমে সারা দেশে প্রায় ৩৫ লাখ টন আউশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। ওই হিসেবে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬ লাখ টন বেশি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সূত্র জানায়, খরিপ-১ মৌসুমে উফশী আউশ উৎপাদন বাড়াতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলায় ৪ লাখ ৫৯ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে মোট ৪০ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ টাকার বীজ ডিএপি, এমওপি সার, পরিবহন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রদান করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ ১ বিঘা জমির জন্য একজন কৃষক মোট ৮৭৫ টাকার প্রণোদনা পেয়েছে। আর এ প্রণোদনা কার্যক্রম শেষ হতে না হতেই করোনা ভাইরাসের থাবায় বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতিতে পরিবর্তন শুরু হয়। সেজন্য আউশের উৎপাদন আরো একটু বাড়িয়ে নিতে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষককে দ্বিতীয় ধাপে আরো সহায়তা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় আউশের জন্য কৃষকদের মাঝে বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি আউশ ছাড়াও মৌসুমের অন্যান্য শস্য বিশেষ করে পাট, তিল ও গ্রীষ্মকালীন সবজি আবাদেও প্রণোদনা সুবিধা পাবেন কৃষক। সূত্র আরো জানায়, আমন ও বোরো মৌসুমের মধ্যবর্তী সময় ফাঁকা জমিতে আউশ চাষ করে অতিরিক্ত ফলনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দেশে আউশের আবাদ মূলত প্রচলিত স্থানীয় জাত দিয়ে করার কারণে উৎপাদনশীলতা বেশ কম। ভালো জাতের অভাবে আউশ চাষ থেকে সরে যাচ্ছে কৃষক। তাছাড়া ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণেও অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আউশের আবাদ ও উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে আউশের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৩ লাখ ৪১ হাজার টন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অর্থবছরে তা বাড়তে থাকে। এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ আবাদ ছিল ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে, ৩৪ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে। ওই সময় উৎপাদন হয়েছিল ৩২ লাখ ৮৭ হাজার টন, যদিও আবাদ হয়েছিল ৩২ লাখ ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে। পরবর্তী এক দশক উৎপাদন ৩০ লাখ টনের ঘরে ছিল। আবাদের পরিমাণও খুব বেশি কমেনি। অবশ্য ১৯৯০ সালের পর থেকেই কমতে থাকে আবাদ ও উৎপাদন। তবে ২০১০-পরবর্তী সময়ে আবার আবাদ ও উৎপাদন বাড়তে থাকে। মাঝেমধ্যে ওঠানামা করলেও আউশ আবাদেকৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেজন্য কয়েক বছর ধরেই আউশ আবাদে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। আর তার সুফলও আসছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ১০ হাজার টনে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২১ লাখ ৩৩ হাজার টন। এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশগত দিক এবং কৃষকের উৎপাদন খরচ বিবেচনায় আউশ আবাদ বাড়াতে হবে। সেজন্য ভর্তুকি সহায়তার পাশাপাশি উন্নত জাতের মাধ্যমে কৃষককে আরো উৎসাহিত করা প্রয়োজন। যে পরিমাণ টাকা কৃষককে দেয়া হচ্ছে, তার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তার তদারকি দরকার। কৃষক ওই টাকা নিয়ে ফসল আবাদ করলো কিনা তা দেখতে হবে। আবার টাকা কৃষককেই দেয়া হচ্ছে কিনা সেটিও দেখতে হবে। ভর্তুকির টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে প্রতিনিয়তই আউশের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বর্তমানে প্রতি কেজি বোরো আবাদে পানি লাগে প্রায় ৩ হাজার ২০০ লিটার। ফলে সেচের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। এ অবস্থায় বোরোর চাপ কমাতে আউশ আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করছে সরকার। কারণ আউশে উৎপাদন খরচ কম। এক একর স্থানীয় জাতের আউশ আবাদে কৃষকের খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর হাইব্রিড জাতের বোরো আবাদে খরচ প্রায় ৫০ হাজার ৪৮৩ টাকা। অর্থাৎ আউশ আবাদে কৃষকের বোরোর তুলনায় খরচ কমে প্রায় ৪২ শতাংশ। তুলনামূলক কম উৎপাদন খরচ এবং সরকারের নানাবিধ ভর্তুকি সহায়তা কার্যক্রম এবং পরিবেশগত বিষয়ের কারণে আউশ আবাদ আবার জনপ্রিয় হচ্ছে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল জানান, আগামী আউশ মৌসুমে কৃষককে সার ও প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের পাশাপাশি নতুন করে বীজ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মূলত করোনা পরিস্থিতির কারণেই এটি দেয়া হচ্ছে। আগের সহায়তা কার্যক্রমে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তারা এ সুবিধা পাবেন না। প্রতিটি কৃষক যাতে আউশ মৌসুমে এ প্রণোদনা পান তা পর্যায়ক্রমে নিশ্চিত করা হবে। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. মো, আবদুর রাজ্জাক জানান, আউশের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য ধরে রাখতে আউশ আবাদ বাড়ানো হবে। উচ্চফলনশীল জাতের আউশ ধান আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি করা হবে। আর আউশ উৎপাদন করোনা পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা আরো জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে।