নিজস্ব প্রতিনিধি : সাইবার অপরাধীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অধিকাংশ মানুষই এখন ঘরে থাকছে। ফলে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই বেশিরভাগ সময় কাটছে। এরই মধ্যে সক্রিয় সাইবার অপরাধীরা ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার ও টুইটার এ্যাকাউন্ট হ্যাক করছে। ফলে নতুন কিছু প্রতারকের আবির্ভাব এবং ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয়ায় অনেক ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা সঙ্কটের সময়ে দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। এই সময়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগেই বেশি মামলা হচ্ছে। তাছাড়া মন্ত্রী, এমপি বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নিয়ে মিথ্যা সংবাদ ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, চিকিৎসা নিয়ে সমালোচনা করা, ত্রাণ চুরির মিথ্যা খবর পরিবেশন করা, ধর্মের অবমাননা, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি প্রভৃতি কারণেও মামলা হচ্ছে। ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস ও লিংক শেয়ারের পাশাপাশি সাইবার অপরাধীরা করোনা নিয়ে গুজব ছড়িয়েও মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। পাশাপাশি অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়েও অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। বর্তমানে ডিজিটাল আইনের মামলার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে মামলায় ৫২ জনকে গেস্খফতার করা হয়। আর চলতি বছরের ২২ জুন পর্যন্ত মোট ১০৮টি মামলা হয়েছে। ওসব মামলায় মোট আসামি ২০৪ জন। তার মধ্যে মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ২৪, মে’তে ৩১ এবং জুন মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ২১ মামলা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব মামলা হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল মাত্র ৬৩টি। আর ২০১৮ সালে ডিএসএ এবং আইসিটি এ্যাক্ট মিলিয়ে মামলা হয়েছিল ৭১টি। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৯ সালে যেখানে এক বছরে মোট মামলা হয়েছে ৬৩টি, সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই মামলা হয়েছে ১০৮টি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ। কারণ অনেক মামলার খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। সেজন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তার খোঁজ পায় না। ফলে অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। ঢাকায় দেশে একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। ডিজিটাল এবং তার আগের আইসিটি আইনের সব মামলার হিসাব সেখানে আছে। ট্রাইব্যুনালের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে মোট ৩২৭টি। জানুয়ারি মাসে মোট মামলা হয়েছে ৮৬টি। তার মধ্যে থানায় ৪১টি এবং আদালতে ৪৫টি। ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে ১১৯টি মামলা। থানায় ৯৫টি এবং আদালতে ৩৪টি। মার্চ মাসে মামলা হয়েছে ১২২টি। তার মধ্যে থানায় ৭৫টি এবং আদালতে ৩৭টি। আর ২০১৯ সালে মোট মামলা হয়েছিল এক হাজার ১৮৯টি। তার মধ্যে থানায় ৭২১টি এবং আদালতে ৪৬৮টি। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫০টির মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা রয়েছে মোট এক হাজার ৯৫৫টি। তার মধ্যে থানায় দায়ের করা এক হাজার ৬৬৮টি এবং আদালতে ২৮৭টি। তবে ৫৫টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে। এদিকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের মামলার সঙ্গে জড়িত আইনজীবীদের মতে, করোনার সময় মামলা বেড়ে যাচ্ছে। মনিটরিং বাড়িয়ে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে সাইবার অপরাধ আরো বাড়বে। ডিজিটাল আইনের ২৫, ২৮ ও ২৯ ধারায় বেশি মামলা হয়। এই ধারাগুলো মানহানি, ধর্মের অবমাননা এবং গুজব ছড়িয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অপরাধ। কিন্তু ওসব অপরাধ সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা নেই। সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের তথ্য মতে, এই আইনে মামলার ৭৫ ভাগই নারী ভিকটিমদের করা। তবে তা আলোচনায় আসে না বা তাদের তথ্য প্রকাশ পায় না। এমনকি তারা প্রকাশ করতেও চান না। বাকি মামলা রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের করা। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা এমপিদের পক্ষ হয়ে অনেকেই মামলা করেন। সাইবার অপরাধে জামিনের বিধান নেই। পুলিশও মামলা করতে পারে। বর্তমানে সবাই অনলাইনে বেশি সময় দিচ্ছে। ফলে সাইবার অপরাধীরা বিভিন্নভাবে তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে, বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে। তাদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সম্প্রতি সাইবার বুলিং নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি সময় অনলাইনে কাটায় তারাই বেশি সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে। অনেকেই অনলাইনে পণ্য অর্ডার দিচ্ছে। তার সুযোগ নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা সাইবার ক্রাইম মনিটরিং করেন, এখন করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যস্ত রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ভুক্তভোগীরা অনলাইনে দামি দ্রব্য কিনতে যায় না। তারা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে কেনাকাটা করে। যখন টাকাটা হারাচ্ছে তখন তারা পুলিশের ফেসবুকে নক করছে, কিন্তু কেউ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে যথাযথভাবে অভিযোগ করছে না। এই জায়গাতে পুলিশকে একটা বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। ভিকটিমওয়াইজ (ভুক্তভোগী) না এগিয়ে সাসপেক্ট ওয়াইজ (সন্দেহভাজন) আগাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ একজন সাসপেক্টকে টার্গেট করলে সেখানে অনেক ভিকটিম পাওয়া যাবে। সেজন্য ডেটাবেজও (উপাদান সংগ্রহ) করা হচ্ছে।